” স্যার – সালাম। আপনাকে একটু তারাতাড়ি গাজীপুরে আসতে হবে।”
আমি বললাম –“কেন? ” আবদুল বলল-“কারন কয়েকদিন হতে খালাম্মা কোনকিছু খাচ্ছে না ও মনে ও করতে পারছে না। ”
শোনার সাথে সাথে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।
আচ্ছা “আবদুল- আসছি।” বলে ফোনটা রাখলাম।
প্রায় ২ বছর পরে মায়ের সাথে দেখা করিনা। মাকে রেখেছি গাজীপুরে “আশার আলো ” নামক এক বৃদ্ধাশ্রমে। মা তো ভালোই ছিল সেখানে হঠাৎ করে খারাপ নিউজের জন্য মনটা ছটফট করছে । গত কয়েকদিন হতে শুধু মায়ের স্বপ্ন দেখি। খুব বেজায় খারাপ স্বপ্ন। মাকে বা কে বা কাঁহারা যেনো তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে?মা সেখান হতে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে ডাকছে।কিন্তু আমি সাহায্য না করে খিলখিল করে হাসছি। মা তারপরও চিৎকার করে ডাকছে “-খোকা – মজিদ! মজিদ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে- বাবা । আয় বাবা আমাকে ধরো- খোকা।” এই স্বপ্ন বার বার আমার দু’চোখে ভেসে আসছে ও মায়ের করুণ চিৎকার কানে বেজে চলেছে। ঐদিকে মায়ের বিপদ এজন্যই হয়তো খারাপ স্বপ্ন দেখছি।
আসলে আমি নিজের সম্পর্কে আর কি বলবো বলুন! ব্যবসা নিয়ে এতোই বিজি ছিলাম যে মাকে গুলসান হতে গাজীপুরে দেখতে আসবো সেই ফুরসত পাচ্ছিলাম না। যদিও মাঝে মধ্যে ছুটিতে থাকি।সেটাও ফেমেলি টূরে চলে যায়।দুই বছর আগে মাকে প্রতিমাসে দেখতে যেতাম সাথে বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের জন্য মাসিক পেমেন্ট দিয়ে আসতাম ।কিন্ত সরাসরি না আসার জন্য বউয়ের চাপাচাপি ও কিছু টা মায়ের কান্না কাটি এসবের ভালো লাগেনা ও আসা হয় না ।যদিও মায়ের জন্য বুকটা চিনচিন করে।হাজার হলেও মা তো। তাই এখন খামে করে বৃদ্ধাশ্রমে প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে দায় সারিয়ে নিই। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য খুব কষ্ট হতো। এখন আর তেমনটা হয়না। সবকিছু মানিয়ে নিয়েছি।
রাস্তায় তেমন একটা যানজট ছিলনা তাই বৃদ্ধাশ্রমে তারাতাড়ি পৌঁছাতেই কেমন যেন একটা স্বর্গীয় অনুভব করলাম। ছেলে ও মায়ের দুইবছর পরে দেখা হচ্ছে কেমন যেন একটা স্বর্গীয় কোন সুখ অনুভব করছি । ইস! আমার সাথে যদি মায়ের সবচেয়ে প্রিয় আমার বড়ো ছেলে রাতুল কে আনতে পারতাম মায়ের মনটা ভরে যেতো। কিনতু আমার ওয়াইফের জন্য আনা তো দূরের কথা বলা সম্ভব হয়নি । আমার ওয়াইফের একটা ধারনা মাথায় চেপে বসেছে এসব দেখে যদি আমার সন্তান রাতুল ও সেরকম কিছু করে বসে ভবিষ্যতে। সেজন্য রাতুল কে তার দাদির সাথে মিশতে ১৪৪ ধারা জারির মতো অবস্থা।
“স্যার – সম্বোধন করে আবদুল হাউমাউ করে কান্না করে দিল। আর বলল- খালাম্মা কোন কিছু মুখে দেয় না ও কোন কথা বলেছে চিনতে ও পারছেনা। উনি খুবই ভালো মানুষ স্যার।
রাতুলের মতো মায়ের ভক্ত দেখি এখানেও জুটে বসে আছে। কে কার জন্য কাঁদে। জগতের নিয়ম মাফিক খুবই জটিল অঙ্কের ধাঁধার মতো যারা অঙ্ক টঙ্ক বুঝে না তাদের জন্য উত্তর কোনদিন মিলেনা। আমি ছোটবেলা থেকে অঙ্কে কাঁচা।
যাইহোক আবদুল কান্না করতে করতেই আমাকে নিয়ে মায়ের রুমে নিয়ে গেলো।
আমি মায়ের রুমের দরজার কাছে গিয়ে একটু চমকে উঠলাম। আমি কাকে দেখছি। মা শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো বলিরেখা পরে গেছে। আমি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে মায়ের কাছে বসে ডাকলাম – “মা,মা ও মা। কেমন আছো,মা ? আমি তোমার মজিদ। তোমার ছেলে মজিদ। ”
মা আমার দিকে মুখ হা করে ফেলফেল করে তাকিয়ে রয়েছে। কোনকিছু বলতে পারছেনা। আমি এভাবে ডেকে বহুবার মায়ের মুখ হতে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করলাম।কিন্তু আমার চেষ্টায় বিফল হলো।
আগে মা আমি আসলে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। রাতুলের কথা জানতে চাইতো। আমি শরীরের ঠিক মতো যত্ন নিচ্ছি কিনা জানতো চাইতো। আজ মায়ের এসবের কিছুই মনে নেই। মাঝে মধ্যে আমার মুখের দিকে তাকাই। মনেহয় আমাকে চেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু নাহ মনে করতে পারছেন না মা । মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইলাম। মা , আমার হাতটা সরিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ পাশে থাকার পরে আবদুলের হাতে খামের টাকাটা দিয়ে বললাম – আবদুল আজ তাহলে আসি।একটু খেয়াল রেখো ভাই মায়ের প্রতি ।
আবদুল বলল “ঠিক আছে, স্যার। আবার আসবেন। ”
আসলে আবদুলরা আছে বলেই আমার মায়ের মতো মানুষেরা সেবা যত্ন নিতে পারে। আগে মা আমি আসার সাথে সাথে কান্না-কাটি করতো সেজন্য বিরক্ত হতাম। আজ মা নিরব কিন্তু সেই অনুভূতি আজ পাচ্ছি না । আজ মায়ের নিরবতায় মায়ের সেই কান্নাকে ভীষণ মিস করছি।
আরে আমি কি আবেগে ভাসছি? সকাল হলে সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যা হলে সকাল হবে। এটাই নিয়ম। হয়তো আমার মা বলেই দুঃখ পাচ্ছি। মায়ের আশে পাশে তো অনেক মা । তারাও আমার মায়ের মতো কোন না কোন পরিবার থেকে এসেছে।রিংটোন বেজে চলেছে বউয়ের ফোন। “মজিদ- বাবু তুমি কোথায় ? ”
আমি বললাম, এইতো শিপু আমি শ্যামলীতে। একটা জরুরি মিটিং এ এসেছি। ”
“তারাতাড়ি চলে এসো বাবু। ”
“আচ্ছা”-বলে কেটে দিলাম।
কি অদ্ভুত নিয়ম পৃথিবীর,তাইনা?
আসলে আমরা কেউ স্বাধীন না।কোন না কোন ভাবে পরাধীন। আমার মতো ঘরজামায়ের স্বাধীনতা তো হ্যালির ধূমকেতু!
আমাকে মাফ করে দিও, মা।