দীর্ঘদিন স্পন্ডালাইটিসসহ নানা রোগে এবং শোকে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন প্রচন্ড সাহসী, প্রাণবন্ত, আড্ডাবাজ, বন্ধুবৎসল এ মানুষটি। একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রিন্টিংয়ের সূত্র ধরে ১৯৯৭ সালে তাঁর সাথে আমার দেখা হয় এবং তখন থেকেই তাঁকে কুঁজো হয়ে হাঁটতে দেখেছি, স্বাভাবিকভাবে তিনি দাঁড়াতে পারতেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রায় পুরো সময়টাই উত্তর নালাপাড়ায় তাঁর প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে এবং আমার স্বজনরা তাঁর পরিচিত হওয়ার কারণে আমি তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলাম খুব অল্প সময়ে। আমার বন্ধুরাসহ তাঁর সাফা’স স্টুডিওতে বসে কত চা খেয়েছি তার কোনও হিসেব নেই, একটাকা বিল কখনও দিতে দেননি। লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে তাঁর মধ্যে একটা ভালোবাসা সবসময়ই প্রত্যক্ষ করেছি। মাঝেমাঝেই ব্যাথাটা অনেক বেড়ে যেতো, তখন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতেই পারতেন না। এমনও হয়েছে অনেক দিন তাঁকে টেক্সিতে করে তাঁর প্রিয় কাজের জায়গা সাফা’স স্টুডিওতে নিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। তখন দেখেছি তাঁকে তাঁর সহধর্মিণী কী অসীম যত্নে আগলে রেখেছিলেন। নিজের স্কুল, সংসার -সন্তান সামলিয়ে সীমাহীন ধৈর্য্যের সাথে দিনের পর দিন স্বামীর সেবাশুশ্রূষা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁর সুন্দরতম সময়।
দীর্ঘরোগ, শোক-ব্যাথা তাঁর প্রাণশক্তিকে দমাতে পারেনি এতটুকু। তিনি শিল্প সংস্কৃতি এবং সৃজনশীল কাজের সাথে নিয়মিত যুক্ত ছিলেন। তাঁকে কখনও আক্ষেপ করতে দেখিনি। অন্যের সুখে তিনি আনন্দ পেতেন এবং অন্যের দুঃখ তাঁকেও কষ্ট দিত।
ঠাট্টা-তামাশা করেই তিনি জীবনটাকে উপভোগ করতে চাইতেন। এইতো ঈদের দিন তিনি স্ট্যাটাস দিলেন,” বিদায় চানা পেঁয়াজু। ”
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তাঁর সাহসী উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করতো সবসময়ই। অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দিতে দেখিনি তাঁকে, রেগে গেলে মুখে যা আসে তাই বলতেন। তাঁর মুখের সেই গালি তখন খারাপ লাগতোনা। দুর্নীতি আর শোষণমুক্ত স্বদেশ দেখতে চেয়েছিলেন সব সময়।
দীর্ঘদিন আমার বিদেশে থাকার কারণে যোগাযোগ ছিলোনা। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবার যোগাযোগ তৈরি হলে খুব আনন্দিত হয়েছিলেন এবং আমি যখন আবার দেশে ফিরে এসে দেখা করতে যাই খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন এই জন্যেই যে মা এবং মাটির টানে বিদেশের নানা প্রলোভন তাঁকেও আটকাতে পারেনি। অর্থের প্রতি প্রলুব্ধ হতে তাঁকে দেখিনি কখনওই। ভাইদেরকে তিনি ভালোবাসতেন প্রচন্ড। সম্প্রতি বিমানের বড়পদে কর্মরত ছোটভাইয়ের মৃত্যুতে তিনি প্রচন্ড মুষড়ে পড়েছিলেন।
সাফায়াত খান শুধু শিল্পীই ছিলেন না, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে শেখননি কখনও আর শেখেননি বলেই হয়তো জীবদ্দশায় তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। এ ব্যর্থতার দায় আমার, আমাদের। প্রার্থনা করি, তিনি ভালো থাকুন অনন্তলোকে।