আমি হিমু না -কবি হিমালয়
রাজ
তেতুঁলিয়া পঞ্চগড়
আমার ঘুম একটু দেরিতে ভাঙে । আজও তাই। বালিশের তলা হতে মোবাইল হাতে নিয়ে চক্ষু চরক গাছ। ‘ও মাই গড’ রানুর ১১ টা কল। ভীষণ জরুরি মনেহচ্ছে। ফোন আসার অপেক্ষায় রইলাম। রানু কল করবে নিশ্চয়ই। কারন সে জানে আমার ফোনে ব্যালান্স থাকেনা। ভাবতেই না ভাবতেই রানুর কল এলো। প্রথমে ৪ হতে ৫ মিনিট বকাবকি। এটা নিয়ম মাফিক রুটিন হয়ে গেছে। “আচ্ছা হিমালয় তোমার কি কোনদিন ও আক্কেল জ্ঞান হবেনা? হুম। ১ বার নয় ২ বার নয় – ১১ টি বার কল দিলাম। কোন উত্তর নেই, রেসপন্স নেই কেন? হুম। আচ্ছা বাবা কল করি আমি। রিসিভ করতে অসুবিধা কোথায়? কবে তোমার এ বদ অভ্যাসটা পরিবর্তন হবে বলো। ”
আমি বললাম -ফোন সাইলেন্ট ছিল,রেণু। সরি। ”
আচ্ছা। ok, আর অজুহাত দেখাতে হবে না। আমি টি.এস.সি.তে আসছি। তুমি ঝটপট তৈরি হয়ে এসো। একথা বলে ফোন কেটে দিল।
আমি ফ্রেস হয়ে টিএসসিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। খোঁচাখোঁচা দারি। এলোমেলো চুলে আয়নার সামনে নিজেকে এক পলক দেখে নিলাম।
পান্জাবীর পকেটে হাত দিলাম। ২০ টাকার একটি নোট। আচ্ছা তাই দিয়ে চলবে। এরপর ম্যাস হতে হেঁটে হেঁটে টিএসসির উদ্দেশ্য রওনা হলাম।রানু আগে ভাগেই এসে বসে আছে। আজকে তাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে। আমি পৌঁছাতে না পৌঁছাতে রানু বলল- হিমালয় একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আমি তারপাশে বসে বললাম – কি?
আগামীকাল আমাকে বরপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে। ছেলে বিসিএস ক্যাডার। আমাদের বাসার সবারই সম্মতি আছে । আমাকে চাপ দিচ্ছে আমি যেন – সেই ছেলেকে পছন্দ করি । বিয়ে করি।
‘তাহলে বিয়ে করে ফেলো।’
রানু আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল- কি বললে আরেকবার বলো দেখি? বিয়ে করে ফেলবো।
আমি বললাম -হুম। তাই করা উচিত। আমার মতো পরগাছাকে বিয়ে করে কি করবে বলো?
রানু আমার বুকে মাথা রেখে বলল- হিমালয় আমি বিয়ে করলে তোমাকেই বিয়ে করবো। তুমি কিছু একটা করো, সোনা।
আমি বললাম – চেষ্টা কি কম করি, রানু?
রানু বলল,তুমি চেষ্টা না ছাই করো। দিনরাত শুধু কবিতা লেখা নিয়ে পরে থাকো। তুমি যে কি হিমালয়?
আমি মৃদুস্বরে হেসে বললাম- তাইনা রানু।
হুম অবশ্যই তাই।
“শুধু ডায়েরি আর ডায়েরি লিখো। সেই পরিচয়ের গত ৪ বছর ধরে শুনছি তোমার কাছে কবিতা প্রকাশ হবে। কবিতার বই বের হবে। কয় হচ্ছে নাতো?
আরে হবে। কবিতার বই প্রকাশ করতে যে খরচ হয়ে থাকে। সেটা তো আমার নেই। তাই হচ্ছে না। টাকা ছাড়া কোনকিছু হচ্ছে না রানু। আমার কি মনেহয় জানো – এ-যুগে স্বয়ং কবি নজরুল কবি হয়ে উঠতে পারতো কিনা সন্দেহ? আর আমার মতো হিমালয়। হা হা হা!
রানু বলল- এই যে দাঁত বের করে হো হো হো করে হেসোনা নাতো। তুমি যদি সবই বুঝতে পারছো। তাহলে কবিতা লেখা ছেড়ে দিচ্ছো না, কেন?
আমি বললাম – রানু সে তুমি বুঝবেনা।
তবে রানু দেখবে।একদিন সত্যি সত্যি সবাইকে অবাক করে দিয়ে, আমার কবিতার কয়েকটি বই একসাথে প্রকাশিত হবে।দেশ- বিদেশে আমার নাম ছড়িয়ে পরবে। একনামে সবাই চিনবে আমাকে -কবি হিমালয়।
রানু বলল- আচ্ছা।আমি এতো কিছু বুঝতে চাইনা। দেখি তাই যেন হয়। কবি মানুষ। সব সময় ভাবনা নিয়ে পরে থাকো। হিমালয় সিরিয়াস হও। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার বউ হতে চাই হিমালয়। বাদাম খাবো হিমালয়। ‘অবশ্যই আমার রাজকুমারী।’স্যার ‘২৫০ গ্রাম – ৩০ টাকা। ২৫০ গ্রাম বাদাম দিই, স্যার।’ আমি বললাম – আরে,না। ২০ টাকার বাদাম দিন। রানুর সাথে বাদাম খেতে মজাই আলাদা। বাদাম খেতে খেতে – রানুকে ধাঁধা ধরিয়ে বললাম – বলোতো রানু – কোন জিনিস গরম নয়। তারপরও মানুষ ফু দিয়ে খাই। জিনিসটার নাম কী?
রানু বলল- আমার ঐসব ধাঁধা, কবিতা মাথায় আসেনা। তুমি কবি মানুষ। তুমিই বলো। আমি বললাম – ধাঁধার উওর -বাদাম।
রানু হেঁসে দিলো। তার হাসিতে একটা আজব মায়া আছে। মনেহয় পৃথিবীর সব পুরুষের সেই আজব হাসিতে বন্দি হতে বেশি সময় লাগবে না। বাসা থেকে ফোন আসছে। আজ উঠি – হিমালয়। আর শোন। ফোন রিসিভ করিও।
ম্যাস হতে সাগরের ফোন এলো। সে বললো – কবি হিমালয় সাহেব আজব, বাইরে খেয়ে নিবেন। কে যেনো আপনার মিল খেয়ে ফেলেছে।এই বলে ফোন কেটে দিল।
পাবলিক ম্যাস গুলোতে এই এক সমস্যা। কোন নিয়ম নেই। কার মিল কে খাই। এ এক আজব সমস্যা।
কি আর করি?
মিরপুর -১০ প্রাইভেট পড়াতে যেতে হবে। টিএসসি হতে মিরপুর -১০। ভাড়া -৪০ টাকা। পকেট তো ফাঁকা।
এতো দূরে হেটে প্রাইভেট সময় মেইনটেইন করাও অসম্ভব। কিনতু আমি হিমালয়। আমি এসব ভাবছি কেন? বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ায় আমার কাজ। মিরপুর -১০ এর বাসে উঠে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পরে বাস কন্টাক্টর এসে বললেন – ভাই কোথায় যাবেন? আমি বললাম – মিরপুর -১০। সে বলল-ভাড়া দেন। আমি বললাম – আমার কাছে কোন টাকা নেই, ভাই। আজ ভাড়া দিতে পারবোনা। সরি।
‘টাকা নেই মানে – ফাজলামো করেন মিয়া। ‘
আমি কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ হতে দুটি কবিতার ডায়েরি বের করে বললাম – সত্যি বলছি। এই দুটি ডায়েরি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই নেই । বিশ্বাস করুন। এই যে দেখুন-পকেটে বের করে দেখালাম।
বাস কন্টাক্টর আরো রেগে গিয়ে বললেন -আরে ভাই। আজব তো। আপনার পকেট দেখে আমি কি করব।
”সত্যি বলছি। আমার কাছে কোন টাকা নেই। ”
”টাকা নেই বাসে চড়ছিলেন কেন? ” এই বলে বিড়বিড় করে আমাকে কিছু একটা কথা বলে চলে গেলেন। বাসে প্রচন্ড ভীড়। আমি বাসের মাঝে দাড়িয়ে আছি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে সময় নিজেকে চিরিয়াখানার প্রাণীর মতো মনেহচ্ছিল । সত্যি আজব জীবন।আজব এ পৃথিবী।
“স্যার, আপনি আজকেও ২৫ মিনিট দেরিতে এসেছেন।- আপনি প্রতিদিন দেরি করেন কেন, স্যার? ”
“শিপু,কথা না বাড়িয়ে বই বের করো। ”
শিপু, ইন্টারমিডেট এ পড়ে। হালকা পাতলা। গায়ের রং তার বেশি ফর্সা না আবার বেশি কালো ও না।তার বাবা একজন সরকারি কর্মচারি। ৪ বছর ধরে শিপুকে টিউশনি করাচ্ছি। সে টাকা দিয়ে আমার জীবন যাপন। ম্যাসের একজন বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এই টিউশনি পাই। ঢাকা শহরে আমার মতো যারা তিতুমীর কলেজ কিংবা ঢাকা কলেজের মতো কলেজে পড়াশোনা করে তাদের টিউশনি মূল্যায়ন তেমন নেই বললেই চলে। এখানে ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকেল, বুয়েট, ডুয়েট পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদেরই মূল্যায়ন বেশি।
শিপু বলল- “স্যার আপনার জন্য একটা Bad News আছে। ”
আমি বললাম – শিপু তোমার Bad newsকি তা জানি?
শহরের রাজপথে একা হাঁটছি। কতো শত শত গাড়ি আনা গোনা। কে কাকে চিনে? কিন্তু সবারই একটা গন্তব্য রয়েছে। কিন্তু আমার কোন গন্তব্য নেই। মনটা ভীষণ ছটফট করছে। ভীষণ কষ্ট লাগছে। যখন সেতু বলল- উনি আপনার কি হোন?
খালা হতবিহ্বল হয়ে পরেছিল।সেতু হয়তো মনে করেছিল আমি খালার কোন বোনের সন্তান। আচ্ছা সেই পরিচয় আরেকদিন না দিবো। আমি হিমালয় পর্বত যেমন মহাসমুদ্রের জলরাশিসম পানি বরফ আকারে রাখতে পারে। আমিও তেমন নিজের পাহাড়সম সমস্যা বুকে জমাট বেঁধে রাখতে জানি। আজ আর ম্যাসে ফিরা সম্ভব না। কারন রাত ১২ টার পরে ফিরা নিষিদ্ধ। দুই একদিন মাফ। আমি তো রেগুলার। মেসের সামনে একটা সেক্টরের পার্ক রয়েছে আজকে রাতটা সেখানেই কাটাতে হবে।পার্ক কোন বিষয় না সমস্যা হচ্ছে মশা। ঢাকা শহরে এতো মশা বাপরে বাপ। বলতে ইচ্ছে করছে ঢাকা শহর মশার শহর।এখানকার মশা গুলো এতোটাই ভয়াবহ যে মশারী ও নরমাল কয়েলে কোন কাজ করে না।
আজকের রাতটা খুবই কষ্টকর রাত হতে চলছে। সমস্যা নেই কতো রাত এভাবে কেটেছি। যার কোন হিসেব নেই।
রেণুর ফোন এলো। হিমালয় তুমি কোথায়?
এইতো রাজপথে হাঁটছি। সাথে তুমি থাকলে কতো ভালো হতো। হিমালয় তোমার সাথে রোমান্টিক ইমোশনাল কথার জন্য ফোন দিইনি।