ঢাকা: ইসরায়েলে নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। হোয়াইট হাউসের সতর্কতা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেল আবিব ও জেরুজালেমে অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কয়েকটি ঠেকাতে সক্ষম হয় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
জেরুজালেম থেকে এক প্রত্যক্ষদর্শী দ্য গার্ডিয়ান অনলাইনকে জানান, তিনি দেখেছেন, মাথার ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র উপকূলের শহরের দিকে উড়ে যাচ্ছে। নিচ থেকে ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তারা দূরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এর আগেও ইসরায়েলে ইরান হামলা চালিয়েছে। তবে এত বড় হামলা এটাই প্রথম।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগেরির উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন জানায়, ইরানের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলে সরাসরি আঘাত হেনেছে। তারা পরিস্থিতি দেখছেন। হতাহতের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
ইরান বলছে, গাজা ও লেবাননে হাজার হাজার মানুষ হত্যা, সেই সঙ্গে হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) নেতা ও কমান্ডার হত্যার প্রতিবাদে তারা এ হামলা চালিয়েছে। আইআরজিসি বলছে, ইসরায়েল জবাব দিলে ত্বরিত পাল্টা আঘাত করা হবে। আলজাজিরা জানায়, ইরানের হামলায় তেল আবিবে অন্তত দু’জন আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্যে এ উত্তেজনা বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়েছেন। এর প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী তাদের নাগরিকদের সুরক্ষিত স্থানে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
অধিকৃত পশ্চিমতীরের রামাল্লা থেকে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মোহাম্মদ খায়রি বলেন, তারা মাথার ওপর দিয়ে কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যেতে দেখেছেন। এগুলো বিরতিহীনভাবে যাচ্ছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে ইসরায়েলের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত অবস্থায় বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা গেছে।
এদিকে, মিত্র দেশগুলোর বাধা উপেক্ষা করে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। পাশাপাশি ট্যাঙ্ক-কামান ব্যবহার করে দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন লক্ষ্যে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বা আইডিএফ। এরই মধ্যে তারা সীমান্তবর্তী ৩০টি গ্রাম খালি করতে বলেছে। এই স্থল অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক। আর স্পেন বলছে, অভিযান যেন দ্রুত স্থগিত করা হয়। অব্যাহতভাবে লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ বিভিন্ন শহরে হামলা চলছে। রকেট ছুড়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছে হিজবুল্লাহও।
গতকাল মঙ্গলবার শুরু হওয়া এ সামরিক অভিযানকে ইসরায়েল ‘সীমিত অভিযান’ বলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলের কমান্ডো ও প্যারাসুটধারী সেনারা সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করেছে। সকালে আইডিএফের এক কর্মকর্তা জানান, সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের তীব্র লড়াই চলছে। তবে পরে জানানো হয়, এ ধরনের কোনো লড়াই এখনও হয়নি। তারা সম্মুখযুদ্ধে জড়াননি। ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ বলছে, ইসরায়েলের সেনারা লেবাননে প্রবেশ করতে পারেনি।
দক্ষিণাঞ্চলে সীমান্ত এলাকায় ট্যাঙ্ক-কামানের গোলাবর্ষণ ছাড়াও মঙ্গলবার বৈরুতসহ বিভিন্ন শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। লেবাননে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া ইসরায়েলের হামলায় শিশুসহ এ পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ অবস্থায় মার্কিন কর্মকর্তারা এএফপিকে বলেন, ইরান ইসরায়েলে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে। এমনটা হলে পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন কর্মকর্তারা।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়তে শুরু করেছিলেন বেসামরিক মানুষ। তবে অনেকের অভিযোগ, ইসরায়েল তাদের অন্যত্র সরে যেতে বললেও যথেষ্ট সময় দেয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, বহু পরিবার শিশুসন্তান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। দক্ষিণাঞ্চলের আইন আবল গ্রামের অন্তত ৬০০ খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ স্থানীয় একটি গির্জায় আশ্রয় নেন। তারা শেষ পর্যন্ত রাজধানী বৈরুতে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্য সামরিক বাহিনীর গাড়ির জন্য তারা অপেক্ষা করছিলেন।
তবে হিজবুল্লাহর এক মুখপাত্র বলেন, তাদের সীমান্তের ভেতরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। যদি তারা প্রবেশ করে, তবে মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য তারা প্রস্তুত। লেবাননের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি ইউনিট রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট সীমান্ত অতিক্রম করে লেবাননে প্রবেশ করে রাতভর অভিযান চালিয়েছে।
হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা শক্তিশালী ‘ফাদি-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মঙ্গলবার ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবে হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বেশি পরিমাণে বিস্ফোরণ বহন এবং দূরের স্থাপনায় হামলা করতে সক্ষম। সম্প্রতি এগুলোর ব্যবহার বাড়িয়েছে হিজবুল্লাহ। সংগঠনটি বলছে, তাদের শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার জেরে তেল আবিবের শহরতলিতে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদরদপ্তরে তারা হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে অন্তত দু’জন আহত হন। একটি ক্ষেপণাস্ত্র মহাসড়কে পড়লে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লেবাননের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেন, লেবানন তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সময়গুলোর একটি পার করছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠককালে মঙ্গলবার তিনি এ কথা বলেন। লেবানন কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরায়েলের হামলায় আট দিনে ১ হাজার ১০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ছয় হাজারের বেশি। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লাখের বেশি লেবাননের মানুষ। এ অবস্থায় স্থল অভিযান তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দরনগরী সিদনের বাসিন্দা আবু আলা বলেন, এবার কেবল হিজবুল্লাহ নয়, পুরো লেবাননই লড়বে। গাজা ও লেবাননে হত্যাযজ্ঞের কারণে পুরো দেশের মানুষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে মজুতের জন্য তাদের অনির্দিষ্টসংখ্যক সেনাসদস্যকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। সোমবার পেন্টাগনের উপপ্রেস সচিব সাবরিনা সিং বলেন, আদেশ পালনের জন্য অনির্দিষ্টসংখ্যক সেনাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর প্রেক্ষাপটে লেবানন থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এরই মধ্যে পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এ কার্যক্রম শুরু করেছে।
স্থল অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক ও রাশিয়া। তুরস্ক একে অবৈধ পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছে। অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল আলবারেস। তিনি বলেন, দক্ষিণ লেবাননে এ ধরনের সংঘাত পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, ইসরায়েলের উচিত অতীতের পুনরাবৃত্তি না করা এবং লেবাননে আটকে না পড়া। এর আগে ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াই করে ইসরায়েল। তখন তারা হেরে গিয়েছিল।
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেসি বোয়েন বলেছেন, এ সংঘাত কোন দিকে যাচ্ছে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। আগে ‘খেলার নিয়ম’ মানা হতো। কিন্তু এখন এ খেলার কোনো নিয়মই নেই। এতে জড়িয়ে পড়তে পারে ইরান; যুক্তরাষ্ট্রও রণতরী নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। কার্যত বৃহৎ এক যুদ্ধের শঙ্কা তো থাকছেই।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হওয়ার পর গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পরে গাজায় হামলার প্রতিবাদে ইসরায়েলে রকেট হামলা চালাতে থাকে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এ পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।