একজন মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণ
ছোট বেলায় রেডিওতে গানের সাথে যে নামটি গীতিকার হিসেবে শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কোন এক বিশেষ মুহুর্তে বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক এসএম মিজান (মামা) একটি প্রোগ্রামে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই মহাপ্রাণের ব্যাক্তির সাথে।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কৃতি সন্তান গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত জমিদার বংশের সন্তান। পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও ছোটবেলা থেকেই দেশ-প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা। দেশপ্রেম ও মানবতার মুক্তির সেই দৃঢ় অঙ্গিকার থেকে তার ভেতরে জন্ম নেয় সৃজনশীলতার অগ্নিশিখা। বুকে ধারণ করে মানবতার মুক্তির চেতনা। মন মগজে লালন করেন মানবতার গান। সেই গান উন্মচিত হয় কলমের মাধ্যমে যা তাকে ধীরে ধীরে পরিণত করে গীতিকারে।
১৯৬৪ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে তার লেখা প্রথম গান প্রচার হয়। সেই থেকে শুরু হয় পথচলা। তারপর কেটে গেছে অর্ধশতাধিক বছর। সৃষ্টি করেছেন হাজার হাজার গান। মুগ্ধ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানের ইতিহাস। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাস লেখা দুরুহ।
অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি।২০ হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন তিনি। সব গান সংরক্ষণ তার কাছে ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের যে ফাঁসির তালিকা তৈরি করেছিল, তাতে ১৩ নম্বরে ছিলেন তিনি। তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে ফিরে এসে দেখেন বাসায় থাকা তার গানের পাণ্ডুলিপি আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখেন সেখানেও তার গানগুলো নেই। পাকবাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে। তবুও রয়ে গেছে হাজার হাজার আলোচিত গান।
সেই গানগুলোর কয়েকটি হল— একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হলো, গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, ও আমার রসিয়া বন্ধু রে…। তার দেশাত্মবোধক গানের দিকে দেখা যাবে, তার প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা’ নামে সিনেমাতে সংগীত পরিচালনা করছেন আনোয়ার পারভেজ। ছবিটি ছয় দফা নিয়ে।গাজী মাজহারুল আনোয়ার গান লিখলেন। তখন এমন পরিস্থিতি গান সুর করার জন্য গীতিকার-সুরকার একসঙ্গে বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এখন যেটা সংসদ ভবন, তখন ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’ বলে পরিচিত ছিল সেই জায়গা। সেই সেকেন্ড ক্যাপিটালের উল্টো দিকে গলির ভেতর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন তারা। মাত্র ২০ মিনিটে তৈরি করে ফেললেন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের কম্পোজিশন। খুবই সতর্কতার সঙ্গে ঢাকা ইন্দিরা রোডে একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে সেই গানটি রেকর্ড করা হলো। চারিদিকে সেনাবাহিনীর টহল। পরিস্থিতি থমথমে, তখন এর ভেতরে গভীর রাত পর্যন্ত এ গান রেকর্ড করা হল। আর এ গানটি আবহ সংগীত করা হলো লাহোরে। এটা জয় বাংলা গানের ইতিহাস।
তিনি পরিণত হন সংগীত ও বাংলা চলচিত্র জগতের এক উজ্জল নক্ষত্রে।পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র সাংবাদিকসহ বাংলাদেশের কিংবদন্তী এই গীতিকার। তার প্রয়াণ দিবসে শোকের ছায়া নেমে আসে সংগীত ও চলচিত্র আঙিনায়। সেখানে সবার প্রিয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন অনেকেই। অনেক তারকাকে বলতে শোনা গিয়েছে যে তাদের অবিভাবক হারিয়েছেন। দেশের সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে নাড়া দিয়ে গেছে তার বিদায়। অনেকে এসেছেন তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে। অনেকে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারন ও তার গুণকীর্তনে মুখরিত ছিল। তার গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য বাংলা গান ও চলচিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র এই গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন মানুষের অন্তরে। তার বিদেহী আত্মার প্রতি দোয়া ও মাগফিরাত কামনা করছি।
মোঃ সুমন মিয়া
লেখক- গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)