কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি ও ভারতের আসাম রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। গত তিন দিন ধরে পাহাড়ি ঢলে উপজেলার জিঞ্জিরাম, কালোর নদী ও ধরণী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪৯গ্রামের ৩৫হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে ৫৯২হেক্টর জমির ফসল ও ৫৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক। পানি উঠায় ৩৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। নৌকা ও কলাগাছের ভেলা পারাপারের একমাত্র ভরসা এসব এলাকার মানুষের। এতে দূর্ভোগে পড়েছেন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের সঙ্কট। গত তিন দিন ধরে পানিবন্দি থাকলেও এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা না পাওয়ার দাবি এসব পানিবন্দি মানুষের।
মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের পুরাতন যাদুরচর, কাশিয়াবাড়ী, লালকুড়া, বিক্রিবিল, চর লাঠিয়ালডাঙ্গা, বালিয়ামারী, শ্রীফলগাতি, খেওয়ারচর, বকবান্দা, আলগারচর, পাহাড়তলী, যাদুরচর পূর্বপাড়া, তিনঘড়িপাড়া, বকবান্ধা, রৌমারী সদর ইউনিয়নের বাওয়াইরগ্রাম, ঝাউবাড়ি, দুবলাবাড়ি, পাটাধোয়াপাড়া, রতনপুর, বামনেরচর, কলাবাড়ি, বড়াইবাড়ি, নতুন চুলিয়ারচর, উত্তর বারবান্দা, মির্জাপাড়া, ইজলামারী, ফুলবাড়ি, চুলিয়ারচর, চরবারবান্ধা, ভুন্দুরচর, নয়ারচর, পশ্চিম মাদারটিলা, গোয়ালগ্রাম, চান্দারচর, খাটিয়ামারী, মাদারটিলা, পূর্বইজলামারী, কড়াইকান্দি ও ঠনঠনিপাড়া এবং শৌলমারী ইউনিয়নের গয়টাপাড়া, কলমেরচর, বেহুলারচর, চরেরগ্রাম, চরবোয়ালমারী, দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ধর্মপুর, কাউয়ারচর, ডিগ্রীরচর, পূর্বকাউয়ারচর বাঘেরহাট ৪৯টি গ্রামের ৩৫হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ঢলে ভেসে গেছে জমিতে থাকা খড় ও মাছের ঘের। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের ধান, পাটসহ নানা ফসলি জমি। এছাড়াও রৌমারীর নতুনবন্দর স্থলবন্দ ও বালিয়ামারী সীমান্ত (বাংলাদেশ-ভারত) হাট পানিতে তলিয়ে গেছে।
মাদারটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহিন আলম জানায়, ‘শ্রেণি কক্ষে বানের পানি ঢুকে পড়ায় কউে বিদ্যালয়ে যায় না। সবার মতো সেও বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।’
রৌমারী সদর ইউনিয়নের চরবারবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। এ জন্য পাঠদান বন্ধ রয়েছে।’
রৌমারী সদর ইউনিয়নের নতুন চুলিয়ারচর গ্রামের কৃষক ছক্কু মিয়া বলেন, ‘কোনো মতে জমির ধান কাটতে পারলেও খড় শুকাতেও পারিনি ও তুলতেও পারি নাই। এখন গরুর মুখে দেওয়ার মতো কোনো খড় নাই। হঠাৎ পাহাড়ি ঢল এসে জমিতে থাকা সব খড় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন গরুর খাবার নিয়ে খুব দু:শ্চিন্তায় আছি। ’
পুরাতন যাদুরচর গ্রামের দিনমজুর সুরুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর সব ডুবি গেছে। এখন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমরা খুব অসহায় পড়ে আছি। সরকারের কোনো অনুদান আমরা পাচ্ছি না। মেম্বার-চেয়ারম্যান, উপজেলার কেউ কোনো খোঁজ-খবর নিতেছে না।’
যাদুরচর ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ি গ্রামের মাছ চাষি আবু সাঈদ বলেন, ‘হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে তার তিনটি পুকুরের পাড় ভেঙে পানিতে তলিয়ে যায়। এসময় পুকুরে চাষ করা সব মাছ বের হয়ে যায়। এতে ক্ষতি হয়েছে তার তিন লাখ টাকা। এ ক্ষতি কেমনে পুষিয়ে উঠবে সে চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি।’
যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরবেশ আলী বলেন, সোমবার পর্যন্ত পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এ ইউনিয়নের ২২গ্রামের ২৫হাজার মানুষ। এছাড়াও ২০০ বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত তার ইউনিয়নের কোনো ত্রাণ পৌছেনি। দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে (পিআইও) অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান বলেন, উপজেলার ২৮ গ্রামের ৩৫হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাউয়ুম চৌধুরী বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এ পর্যন্ত (সোমবার) উপজেলার ৫৯২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তারমধ্যে আউশ ধান ১৪৭ হেক্টর, পাট ২২৩ হেক্টর, ২২২ হেক্টর শাকসবজি ও তিল তলিয়ে গেছে।
রৌমারী উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী মেজবাহ আলম বলেন, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার তিন ইউনিয়নের ৫৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ৩৭টি বিদ্যালয় পানিবন্দি হয়ে পড়ায় সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানি কমে গেলে নিয়মিত পাঠদান শুরু করা হবে বলে জানান ওই শিক্ষা কর্মকর্তা।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশারাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘জিআরের বরাদ্দ থেকে ৩লাখ টাকার শুকনো খাবার কিনা হয়েছে। তা দ্রুত পানিবন্দি মানুষের মাঝে সরবরাহ করা হবে। আরও বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই তা বিতরণ করা হবে।’