রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সাবেক সভাপতি, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদ (জিএস) এবং সাংবাদিক মতিউর রহমান বাচ্চু ভাইয়ের আজ ১১-তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের আজকের এইদিনে তিনি স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী প্রফেসর মমতাজ বেগম রানি এবং দুই মেয়ে – শাওলী ও চৈতীকে রেখে যান। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আমিন।
মতিউর রহমান বাচ্চু ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি পাবনা শহরের জুবিলী ট্যাঙ্কপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বেলায়েত হোসেন মোক্তার ও মাতা কদবানু হোসেন। চার ভাইয়ের মধ্যে মতিউর রহমান দ্বিতীয়। বড়োভাই আবদুল মতিন ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ভাষাসৈনিক।
মতিউর রহমান বাচ্চু পাবনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে আইএ পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করেন।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে বাল্যকাল থেকেই মতিউর রহমান বাচ্চু রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে কারাবরণ করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর ঢাকায় ৩ দিনব্যাপী গোপন বৈঠকে যোগ দেন। এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে প্রথমে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৫-৬৬) নির্বাচিত হন। ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির (মতিয়া গ্রুপ) সহ সভাপতি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৮ সালে রাকসুর নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ’৬৯-এর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এরপর বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মতিউর রহমান বাচ্চু সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
মহিমচন্দ্র জুবিলী হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি কিশোর আবৃত্তিকার ও বিতার্কিক হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। পাবনা জেলা স্কুলে তার স্ফুরণ ঘটে। জেলা স্কুলের বার্ষিক সাহিত্য ও সংগীত প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি ও বিতর্কে পুরস্কার লাভ করেন। এবং এই স্কুলে অধ্যয়নকালীন পাবনা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক আনোয়ার পাশার (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন) সহায়তায় তিনি স্বহস্তে নানা কলেবরে কলেজে প্রকাশ করেন দেয়াল পত্রিকা ‘অনির্বাণ’। জুবিলী ট্যাঙ্কপাড়াতে গঠন করেন ‘নিউ লাইট ক্লাব’। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে শহরে তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মঞ্চনাটক মঞ্চস্থ, পরিচালনা ও অভিনয় করেন তিনি। এসব ক্ষেত্রে পাবনায় এক নতুন যাত্রা যুক্ত করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গীতিনকশা রচনা ও পরিচালনা এবং বিচিত্রা অনুষ্ঠান তৈরিতে মতিউরের সক্রিয় ভূমিকা সবার দৃষ্টি কাড়ে। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক পরিচালনা এবং কেন্দ্রীয় সংসদের নাটকে অভিনয় করে বেশ প্রশংসিত হন। তার কবিতাসহ অন্যান্য ৫ জনের কবিতা সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় ‘অন্তরঙ্গ কবিতাগুচ্ছ’- যা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশংসিত হয়।
কর্মজীবনের প্রথমে ১৯৭০ সালে মতিউর রহমান বাচ্চু পাবনা বুলবুল কলেজে (বর্তমানে শহিদ সরকারি বুলবুল কলেজ) প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর মাধপুর এ কে কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা-উত্তর মতিউর রহমান সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার ‘দৈনিক বাংলা’ অফিসে। ১৯৭৩ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত “দৈনিক জনপদ’-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং ‘নীলকণ্ঠ’ ছদ্মনামে কলাম লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং যোগ্যতার গুণে দৈনিক জনপদের উপ ইউনিট প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে সরকারি নির্দেশে অন্যান্য কাগজের সঙ্গে দৈনিক জনপদ অবলুপ্ত হলে তিনি বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরবর্তীকালে তথ্য মন্ত্রণালয়ধীন জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে গণসংযোগ সদর দফতর, কুষ্টিয়া তথ্য অফিস ও চট্টগ্রাম তথ্য অফিসে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং যোগ দেন ব্র্যাক প্রকাশিত মাসিক ‘গণকেন্দ্র’ পত্রিকায় ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পদে। পাশাপাশি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’তে স্বনামে এবং ‘বিরসকণ্ঠ’ ও ‘মিতবাক’ ছদ্মনামে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। এক পর্যাথয়ে তিনি ব্র্যাকের চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে দৈনিক জনতা, সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায় লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। ‘অ্যাডস্ট্রিম’ নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা গঠন করেন। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র মুক্তির পর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ম্যাগাজিন সাইজের ‘পাক্ষিক কিছুক্ষণ’ পত্রিকা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি কিছুকাল উন্নয়নমূলক ও আলো বিশেষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সুনাম অর্জন করেন। ‘উদ্গম’ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের এনজিওগুলোর সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং শোষিত নারীর কল্যাণে কী কাজ করছে, সাংবাদিকের দৃষ্টিতে তার গবেষণা ও মূল্যায়ন ছিল উদ্গম’-এর কাজ।
মতিউর রহমান বাচ্চুর লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে : বেলা-অবেলার কথা, নিরন্তর পারাপার (গদ্য), ঝাড়বাতির আলোছায়া (কবিতা)। দৈনিক ডেসটিনি, দৈনিক জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। ফ্রি-ল্যান্সার, বিজ্ঞাপননির্মাতা ও পাক্ষিক কিছুক্ষণ পত্রিকা প্রকাশনার মধ্যে আমৃত্যু নিমগ্ন ছিলেন মতিউর রহমান বাচ্চু।
লেখকঃ মোঃ মহিউদ্দিন ভূইয়া।