অলোক আচার্য, পাবনাঃ আকাশের বয়স ৮৭ বছর আর ঝর্ণা দাসের ৬২। ভাই—বোনের জীবনযাপন বেশ রহস্যঘেরা মনে হতে পারে অনেকের কাছে। প্রকৃতিকে ভালোবেসেই জীবনের প্রায় শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছেন তারা। তবে এখনো বিয়ে করেননি কেউই। গড়েননি নতুন পরিবার, আগ্রহ নেই সামাজিক জীবনের।আশ—পাশে নেই জনজীবন ও কোলাহল। পাখিদের কিচির—মিচির, সবুজ প্রকৃতির সমারোহে মাঝে—মধ্যে দেখা মেলে অচেনা পাখির। কিছুটা ভুতুড়ে, গা ছমছমে এই পরিবেশের মাঝেই বাস করেন ভাই—বোন আকাশ কলি দাস ও ঝর্ণা দাস।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আগ্রহ না থাকলেও ভালোবাসেন প্রকৃতি ও পশু—পাখি। আকাশ কলি দাস কাকেশ্বরী নদীর পাড়ে প্রায় সাড়ে ৬ বিঘার বসতভিটার পুরোটাই মুক্ত করে দিয়েছেন পাখিদের জন্য। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন একটা বন। পাখিদের অবাধ বিচরণের জন্য জায়গাটিকে সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। ইট—পাথরের নগরায়ণের ফলে পাখিরা যখন আপন নিবাস হারাচ্ছেন, ঠিক তখন আশ্রয় নেওয়া পাখিদের নিরাপদে থাকার জন্য নিজের বসতভিটা মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। কেউ সেখানে পাখি শিকারের চেষ্টা করলেও শক্তভাবে প্রতিরোধ করেন। এখানে প্রকৃতি আপন খেয়ালে বেড়ে উঠছে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। তবে মাঝে মধ্যেই পাখিদের কোলাহল সেই নীরবতা ভেদ করে চাঞ্চল্য ছড়ায়। মানুষের আনাগোনা না থাকায় এখানে পাখিরা থাকে উন্মাদনায় ব্যস্ত থাকে। প্রকৃতিও এখানে আপন রূপে রুপান্তিত হয় সবসময়ই। প্রকৃতির উন্মাদনায় মধ্যে খানিকটা ভীতিও ছড়াবে। সেই ভুতুড়ে জঙ্গলে রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের গাছ সেখানে দেখা মেলে শতশত রকমের পাখি ও অচেনা কিছু পাখিদের। জঙ্গল থেকে কাটা হয়না কোন গাছ। কুকুর—শিয়াল—সাপ সবকিছুরই দেখা মিলবে সেখানে, জমজমাট আসর বসায় অতিথি পাখিরাও। আকাশ কলি আগলে রেখেছেন শত বছরের পুরনো একটা লতা গাছ। তার দাবি— গাছটির নাম কেউ জানেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের প্রফেসর মনিরুল ইসলাম খান এসেছিলেন এই গাছ দেখতে তিনি সেই গাছের নাম দিতে পারেননি। এছাড়াও জার্মানি ও লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকরা এসেছিলেন তারাও এই গাছটির নাম জানাতে পারেননি।
সরেজমিনে পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা ইউনিয়নের কৈটোলা গ্রামের বাসিন্দা আকাশ কলি দাস ও ঝর্ণা দাসের সাথে আলাপকালে তারা জানান, বাবা চন্দ্র কুমার দাস পাবনার নগরবাড়ির শ্রী নিবাস দিয়ার জমিদার বাড়ির নায়েব ছিলেন। ১৮—২০ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরেন আকাশ। তিন ভাই—তিন বোনের সংসারে তিনিই ছিলেন অভিভাবক। ছোট বেলাতে এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়। অবশিষ্ট এক ভাই ও দুই বোনকে স্বাধীনতার আগেই ভারতে বিয়ে দেন। বিয়ের পর তাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি। পাঁচ ভাই—বোনের মধ্যে তারা দুইজন ছাড়া আত্মীয়—স্বজন সবার বসবাস ভারতে। এখানে নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। বয়সের ভারে পারকিনসন্সেও আক্রান্ত আকাশ দাসের একাকিত্বই বেশি পছন্দ। প্রায় সাড়ে ৬ বিঘার জমির উপর কাকেশ^রী নদীর পাশে ছোট্ট চার চালা ঘরে ভাই—বোনের বসবাস। ঘরটিও দুইশ বছরের পুরোনো তবে কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে কিন্তু সেই পুরনো জিনিসপত্র দিয়েই। আরেকটি ছোট দোচালা ঘরে চলে ভাই—বোনের রান্নাসহ আনুষঙ্গিক কাজ। পাশে দুটি গোয়াল ঘরও রয়েছে। বসতভিটায় সাড়ে ৬ বিঘার সম্পত্তির পাশাপাশি মাঠে অর্ধ—শতাধিক বিঘা জমি থাকলেও খুব অনাড়ম্বর জীবন—যাপন করেন তারা। সম্পত্তি নিয়েও তাদের কোনো চিন্তা নেই। ঝড়—বৃষ্টির মাঝেও ভাই—বোনের চিন্তাহীন জীবন। অসুখ—বিসুখ নিয়েও তাদের নেই কোনো ভাবনা। তবে বর্তমানে আকাশ কলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঠিকমত হাটা চলা করতে পারেন না। গরু ও মাঠের কাজে জন্য রাখাল ও শ্রমিক রাখা আছে। এখন নিরিবিলি জীবন কাঁটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা। একাকিত্বই তাদের ভালো লাগে। ঝর্ণা দাস বেশির ভাগ সময় কাটান বই পড়ে। আকাশ বইয়ের পাশাপাশি পশু—পাখি ও প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান। তার একাকিত্বের কিছু সময় লাঘব করেন পশু—পাখি ও প্রকৃতির সঙ্গে।
কুমার জীবন নিয়ে আকাশ দাস জানান, বিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্বশীল অভিভাবকের অভাবে আজও কুমার তিনি। বোনকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে রাজি না হওয়ায় তাকেও আর বিয়ে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, পাখিরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফসল উৎপাদনেও অবদান রাখে। কিন্তু মানুষ এই পাখিগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করছে। শিক্ষিত ও ধনীরা পাখিগুলো কিনে খায় বলেই অনেকে পাখি শিকার করতে উৎসাহী হন। আমাদের দেশে যত পাখি আসে সব পাখি ফিরে যায় না। তাদের হত্যা করা না হলে আমাদের দেশেও সারা বছরই এমন পাখির বসবাস থাকত। এক সময় গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও নিজেকে স্বল্প শিক্ষিত দাবি করেন আকাশ দাস। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। সামাজিকতায় সম্পৃক্ত থাকলেও এখন আর সেভাবে যান না। তার সম্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তারা এসেছেন একা— যাবেন একা। তারা সম্পত্তি নিয়ে আসেননি, তাই সম্পত্তি নিয়েও যাবেন না। তাদের মৃত্যুর পর যার কপালে সম্পত্তি রয়েছে, তিনিই পাবেন।
আকাশ দাসের ব্যতিক্রমী জীবযাপন নিয়ে বেড়া উপজেলার কৈটোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহসিন উদ্দিন পিপল বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত দানশীল ও আদর্শবান মানুষ। উনার দানে অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়েছে। উনাকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। দেশের প্রতি ভালোবাসায় তিনি পরিবারের সঙ্গে ভারতে যাননি। সব ধরনের পাখির প্রতি তার ভালোবাসা রয়েছে।’বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মো. মোরশেদুল ইসলাম জানান ‘আমি কিছুদিন হল এ উপজেলায় যোগদান করেছি তার বিষয়ে শুধু লোকমুখে জেনেছি। আমি সময়করে তাদের বাড়িতে যাব। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেব। তারা যদি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চায় অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।’