মোঃ সুমন মিয়া: মরুভূমি ও পাহাড় পর্বতের দেশে এক খণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত নগরী তায়েফ। ফুল, ফল ও ফসলের সমারোহ সেখানে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনের খোরাক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরীও বটে। পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ। এ শহর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চমৎকার সাজানো গোছানো একটি শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এ শহর দেখতে হাজিরা কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখেন।
পাহাড় কেটে বানানো রাস্তাটি একমুখী। অনেক উপরে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, কান বন্ধ হয়ে যায় আপনা-আপনি। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝক্ঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা চিন্তা করা যায়? পাহাড় দেখে মানুষ কেন আপ্লুত হয়, সেটা তায়েফের পাহাড় না দেখলে জানা হত না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর আকাশের সত্যিকারের নীল এক সাথে দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে।
ওমরার হাজীগন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এখানে আসতে হয়। তাই আমরা সেভাবেই মাইক্রো ভাড়া করে মক্কা নগরের মিসফালাহর হিজরা মসজিদ এর সামনে থেকে রওয়ানা দিলাম। মক্কা নগরের নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও আধুনিক স্থাপত্য অতিক্রম করে আমাদের গাড়ি চলছে। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক ও টানেল। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও আছে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। প্রাণীকুলের মধ্যে উট আর দুম্বা। বৃক্ষ বলতে শুধুই বাবলা গাছ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি।
শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। সড়ক দ্বীপে বানরের দল নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। যা আমাদের জন্য মায়াবী পথে চমৎকার এক যাত্রা। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।
তায়েফ সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের একটি শহর এবং গভর্নরেট। ১,৮৭৯ মি (৬,১৬৫ ফু) উচ্চতায় হেজাজ পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত। যেটি নিজেই সারাওয়াত পর্বতমালার অংশ। ২০২০ সালের হিসাব মতে আনুমানিক শহরটির জনসংখ্যা ৬৮৮,৬৯৩ জন যা এটিকে রাজ্যের ৬ষ্ঠ জনবহুল শহর করে তুলেছে।
কুরআনে সূরা আয্-যুখরুফ (৪৩) এর ৩১ নং আয়াতে তায়েফকে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।শহরটি ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে কোন এক সময়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিদর্শন করেছিলেন এবং বনু ছাকিফ গোত্র বসবাস করেছিল এবং এখনও তাদের বংশধরদেরেরা বসবাস করা হয়েছে। হেজাজের একটি অংশ হিসেবে। শহরটি তার ইতিহাস জুড়ে অনেক ক্ষমতার হস্তান্তর দেখেছে। সর্বশেষটি ১৯২৫ সালে হেজাজের সৌদি বিজয়ের সময় হয়েছিল।
শহরটিকে সৌদি আরবের অনানুষ্ঠানিক গ্রীষ্মকালীন রাজধানী বলা হয়। কারণ এখানে গ্রীষ্মকালে একটি মাঝারি আবহাওয়া বিরাজ করে। আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এখানে ভিন্ন। শহরটির অনেক পাহাড়ি রিসর্ট এবং মাঝারি জলবায়ুর কারণে পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে। আইকনিক হাইওয়ে ১৫ (তাইফ-আল-হাদা রোড) এর মাধ্যমে নিকটবর্তী অবলম্বন শহর আল-হাদার সাথে শহরটি সংযুক্ত। এটি হেজাজ অঞ্চলের বাকি অংশ থেকে আলাদা কারণ এটি একটি শহর যা সৌদি আরবের কৃষি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধু চাষের।