বীরমুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল (১৯৫০-২০১৬)-এর আজ ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের আজকের এই দিনে তিনি ঢাকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউশনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আমিন।
বীরমুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের জন্ম ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লায় মাতুলালয়ে। টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার সারেতপুর গ্রামে তাঁর পৈতৃক নিবাস । পিতা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খন্দকার মোহাম্মদ শাহজাহান। মা রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও পূর্ববাংলা আইনসভার সাবেক সদস্য সেলিনা বানু। তিন ভাইবোনের মধ্যে শিরিন বানু মিতিল জ্যেষ্ঠ।
শিরিন বানু মিতিল শৈলরানি বালিকা বিদ্যালয়, কুমিল্লা থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি এবং মহিলা কলেজ, কুমিল্লা থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি পাস করেন । এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলায় অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন । সেখানে অধ্যয়নকালে কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন ।পরবর্তীতে পারিবারিক কারণে কলেজ পরিবর্তন করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অনার্সে ভর্তি হন । এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে সাবসিডিয়ারি পাস করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে অবস্থিত প্যাট্রিস লুলুম্বা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং অ্যাডভান্স কোর্স সম্পন্ন করে ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন । বাবা-মা দুজনেই বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় পারিবারিকভাবেই শিরিন বানু মিতিল রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হন।
পাবনা শহরে নানা খান বাহাদুর ওয়াছিম উদ্দিন আহমদ (১৮৬৩–১৯২৮)-এর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য মিতিলের রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। মামারা গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। মা সেলিনা বানু সে আমলে সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির স্টাডি সার্কেল ও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন । সেলিনা বানু ছাত্র ফেডারেশন, পাবনা জেলা শাখার সহ সভাপতি এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।বাবা খন্দকার মোহাম্মদ শাহজাহান খিদিরপুর ডক-শ্রমিক ও পাবনা রেল-শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ২০১০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কারণেই আমাকে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এছাড়া মা বলতেন, “ঘরে বসে মরার জন্য তোদের আমি জন্ম দেই নি। ঘর থেকে বের হয়ে দেশের জন্য একটা কিছু কর।” বড়ো খালা এবং ফুপু বলেছিলেন, “যুদ্ধে যাচ্ছো যাও তবে তোমাদের পিঠে যেন গুলি না লাগে ।” মামাতো ভাই জিদান জিঞ্জির বলেছিলেন, “তুমি প্রীতিলতার মতো প্যান্ট-শার্ট পরে যুদ্ধে যেতে পারো।” এই সব কথা মিতিলের মনে ভীষণভাবে গেঁথে গেল। তাছাড়া বাম রাজনীতির একজন আদর্শিক সৈনিক হিসেবে তাঁর স্বপ্নে ছিল কিউবা, ভিয়েতনাম ।
একাত্তরের যুদ্ধের সময় পাবনা প্রতিরোধের জন্য ডিসি নূরুল কাদের বিপ্লবী কমিটি গঠন করেন । এই কমিটিতে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা, আমজাদ হোসেন (এমএলএ), সৈয়দ ফজলে হোসেন আবদুর রব বগা মিয়া সহ অনেকেই । প্রতিরোধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলে, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর ওপর। ফলে শতাধিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পাবনার মাটিতে হত্যা করে সুসংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা।
নগরবাড়ি ঘাটে যুদ্ধ চলাকালে কন্ট্রোলরুমের দায়িত্ব পড়ে শিরিন বানু মিতিলের ওপর। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশের সঙ্গে কাজ করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। ফলে সেখান থেকে পালিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে চুয়াডাঙ্গা এসে স্বাধীন বাংলা সরকারের ঘোষণা শুনে মিতিল অস্ত্রের উদ্দেশে ভারত যাওয়ার একটি গ্রুপের সঙ্গে ভারত যান এবং সেখানে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সহায়ক সমিতিতে পৌঁছান । সেখানে মিতিল খন্দকার নামে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত করেন । এক সাংবাদিক, ছেলে সেজে যুদ্ধ করার ঘটনাটি কাগজে প্রকাশ করেন এবং দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মিতিল কিংবদন্তি নারী নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও মন্ত্রী কামারুজ্জামানের সহযোগিতায় মহিলাদের একমাত্র সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প “গোবরা ক্যাম্প”-এ যোগ দেন। গোবরা ক্যাম্পের মূল দায়িত্বে ছিলেন সাজেদা চৌধুরী।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্যান্ট-শার্ট পরে পুরুষের বেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তিন সন্তানের জননী শিরিন বানু মিতিল আমৃত্যু নারী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক।