শেখ নুরুল আবছার নিসু,ব্যূরো প্রধান,চট্রগ্রাম।
জন্ম থেকে জীবন যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী সাদেক আহম্মদ। ৪৫ বছর বয়সী সাদেকের পথ চলতে হয় দু’হাতে লাঠি ভর দিয়ে। জন্ম থেকে স্বাভাবিক নয় দুই পা। ৩ কন্যা সন্তানের জনক সাদেকের নুন আনতে পান্তা পুরোয় অবস্থা। পরিবারের ৫ জনের ভরণপোষণ করতে গিয়ে নিত্যদিন তাকে হিমশিম খেতে হয়। প্রতিবন্ধী হলেও কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের জীবনকে সাজিয়ে তোলার জন্য নানা সময় নানা পন্থা অবলম্বনও করেন। সাদেক মিরসরাই উপজেলার ২ নং হিঙ্গুলী ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রামের সানু মিয়ার পুত্র। অভাবের সংসারে পড়াশোনা করাতে পারেনি তিন মেয়ে জেসমিন আক্তার, সামিনা ডাক্তার ও মোহনা আক্তার পিংকিকে। তিনি প্রথমে উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরবাজারে বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু তাতেও সংসারের খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসে বাদাম ও বুট বিক্রি করে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও সচ্ছলতা ফিরছিল না। কোন উপায়ন্ত না পেয়ে প্যাডেলচালিত রিকশাও চালিয়েছেন কিন্তু তার দু’পা স্বাভাবিক না হওয়ায় তাও দীর্ঘদিন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ভিক্ষাবৃত্তি করবেন প্রায় ৬ বছর ভিক্ষাবৃত্তি করেই সংসার চালিয়েছেন। একটা পর্যায়ে নিজের মধ্যে উপলব্দি আসে ভিক্ষাবৃত্তির জীবন কখনো সম্মানের হতে পারে না। যখন থেকে ওই উপলব্ধি তার উপর ভর করে তখন থেকে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেন। এরিমধ্যে সাদেকের দেখা হয় বারইয়ারহাট পৌরবাজারের ব্যবসায়ী আবু সাইদ তুহিনের সাথে। সাদেক তুহিনকে তার জীবনের দুঃখগাঁথা লিপি তুলে ধরেন। সাদেকের জীবনের বেদনার গল্প শুনে তার জীবন বদলে দেওয়ার পন্থাও আঁকেন তুহিন। মনস্থির করেন প্যাডেলবিহীন একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে দেবেন। এতে যোগ করেন ব্যবসায়ী মিরাজ উদ্দিন ও শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহম্মেদ ফাহিমকে। তিন জনের সমন্বিত উদ্যোগে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সাদেকের জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট করতে থাকেন। ২১ জুলাই থেকে তারা পোস্ট করা শুরু করেন এবং স্বল্প সময়ে তারা ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। তারপর তারা রিকশা ক্রয় করে শুক্রবার সাদেকের হাতে তুলে দেন। আর রিকশাটির নাম দেন ‘মানবতার রিকশা’। দেশ ও প্রবাসে থাকা মানবতাবাদীদের আর্থিক সহায়তায় ক্রয় করার কারণে রিকশাটির ওই নামকরণ করা হয়। সাদেকের হাতে রিকশা হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন বারইয়ারহাট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নিজাম উদ্দিন আনছারী, বারইয়ারহাট পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফ উদ্দিন মাসুদ, ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন নিপুন, হারুন, আবু সাইদ তুহিন, মিরাজ উদ্দিন, ইশতিয়াক আহম্মেদ ফাহিম।
মানবতার রিকশা ক্রয়ের মূল উদ্যোক্তা আবু সাইদ তুহিন বলেন, ‘সাদেক আহম্মেদ ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে চান এমনই আমাকে বললে আমি, মিরাজ উদ্দিন, ইশতিয়াক আহম্মেদ ফাহিম মিলে ফেসবুকে তার জন্য আর্থিক সহয়তা চেয়ে পোস্ট করতে থাকি। এতে দেশে এবং প্রবাসে অবস্থানরত মিরসরাইয়ের অনেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। আমরা সাদেককে রিকশা ক্রয় করে দিতে পেরে নিজেদেরকে ধন্য মনে করছি, পাশাপাশি যাদের আর্থিক সহায়তায় রিকশা ক্রয় করে দিতে সক্ষম হয়েছি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’
ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন নিপুন বলেন. ‘সাদেক জন্ম থেকে জীবন যুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। আমরা উদ্যোগ নিয়ে ইতিপূর্বে তার বসতঘর নির্মাণের সময় টিন ক্রয়ে আর্থিক সহায়তা করি। এছাড়া আমাদের কিছু শুভাকাঙ্খীদের আর্থিক সহায়তায় সে যেন সুন্দরভাবে পথ চলতে পারে সেজন্য তাকে একটি হুইল চেয়ারও ক্রয় করে দিই। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে সাদেক এবার নিজের জীবন বদলে দিতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি।’
সাদেক আহম্মদ অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমার জীবনের পরতে পরতে মানুষের অনেক অবদান রয়েছে। আমি তাদের জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদের সবসময় সর্বাবস্থায় ভালো রাখে। আমার জীবনের এত বড় উপহার এর আগে আমি পাইনি। রিকশাটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং দামী উপহার। যারা আমাকে রিকশা কিনতে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’