অতি সম্প্রতি কোন এক অনুষ্ঠানে সরকারের মাননীয় ভূমি মন্ত্রী মহোদয়কে আক্ষেপের সাথে বলতে শোনা যায়, ‘রেজিষ্ট্রি অফিস কেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নয়!’ বিগত দিনের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বারবার ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রেজিষ্ট্রেশন দপ্তরের কার্যক্রম একই ছাদের নীচে আনার বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উত্থাপনসহ সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ভূমি মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হলেও আলোচনা টেবিল পর্যন্ত গড়ানোর বাইরে তেমন ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। ফলে বলা যায়, বিশেষ করে ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতার অভাবে এটি অদ্যাবধি সম্ভব হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে নেয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে দেখা যায়, ২০১৫ সালে তদকালীন ভূমি মন্ত্রী জনাব শামসুর রহমান শরীফ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জনাব গওহর রিজভীকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবার আহবান জানিয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আইন মন্ত্রনালয়ের অধীনে থাকা সাব-রেজিষ্ট্রি কার্যালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার সুপারিশ করেছিল।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় মাঠপর্যায়ে ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-র কার্যালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস একই ছাতার নীচে আনার লক্ষ্যে প্রায় দু’দশক পূর্বে ভূমি মন্ত্রণালয় অষ্ট্রেলিয়ান একটি সংস্থার সাথে যৌথভাবে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সে সময়ে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লেখকদের সমিতি কর্তৃক তীব্র বিরোধিতা এবং নানামুখী তদবিরের ফলে সে উদ্যোগ থেমে গিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা বর্তমান মন্ত্রী জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ-র তরফ থেকে এরকম আক্ষেপের কথা শোনার পর আমরা আশা করতে পারি খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিশ্চয় দেখতে পাবো। কেননা তিনি এ মন্ত্রনালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নেয়া অনেকগুলো ইতিবাচক ও ফলপ্রসু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেখেছি এবং আরো অনেক উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।
ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রেজিষ্ট্রেশন বিভাগ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সরকারের আইনি কাঠামোর সাথে সংযুক্ত ছিল। অন্যদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা বা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অনেকটা সময় পর্যন্ত জমিদারী প্রথার আওতাভূক্ত ছিল। মূলতঃ ১৯৫০ সনে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরেই ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারের আইনি কাঠামোয় অন্তর্ভূক্ত হয়। বলা যায়, সে সময়টাতে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানকে অঙ্গীভূত করার চমতকার সুযোগ ছিল। কিন্তু ভূমির আদি ব্যবস্থাপনার খোলস থেকে বের করে আনার এই যে ঐতিহাসিক আইন প্রণয়ন তথা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনকালে অন্য কোন সংস্কারের দিকে দৃষ্টি দেয়ারও সুযোগ হয়তো ছিল না। তবে ১৯৫০ পরবর্তী সময়ে এমন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নানা সময়ে সামনে এলেও সংশ্লিষ্টদের পাশ কাটানো মনোভাবের কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এমন ও নয় যে এটি করতে গেলে নতুন করে আইন প্রণয়ন কিংবা অধ্যাদেশ জারীর প্রয়োজন আছে। দুটি দপ্তরই স্ব স্ব ক্ষেত্রে যে আইন এবং বিধি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে সেভাবেই থাকবে, শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পরিবর্তন হবার ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তই হয়তো যথেষ্ট।
রেজিষ্ট্রেশন বিভাগ এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি প্রতিষ্ঠান।অন্যদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন তারও আগে।উভয় বিভাগের কার্যক্রম মূলতঃ পরিচালিত হয় মাটি ও মানুষকে ঘিরে।দেশের আপামর জনগণের সাথে এ দু’টি বিভাগের কার্যক্রম সম্পৃক্ত।উভয় প্রতিষ্ঠানই জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে সেবা প্রদান করে থাকে।১৮৮৫ সনে প্রবর্তিত বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব ব্যবস্থা ১৯৫০ সনে জমিদারী অধিগ্রহণ পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অনেকাংশে জমিদারদের অধীনে পরিচালিত হয়েছে এবং তদকালীন শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ অনুযায়ী যতটুকু প্রয়োজন ছিল ঠিক ততটুকু সংস্কারই সাধিত হয়েছে।অন্যদিকে বৃটিশ শাসনামলে ১৭৮১ সনে সর্বপ্রথম বেঙ্গল স্ট্যাটিটিউট এর অধীনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়।পরবর্তীতে ১৭৯৩ সনে ৩৬ নং বেঙ্গল রেগুলেশনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ঢাকায় রেজিষ্ট্রি অফিস স্থাপন করা হয়।এর শতাব্দীকালেরও অধিক সময় পরে ১৯০৮ সনে (১৯০৮ সনের ১৬ নং আইন) উপমহাদেশের পূর্ণাঙ্গ রেজিষ্ট্রেশন আইনের প্রবর্তন হয়।এবং উক্ত আইন দ্বারাই অদ্যাবধি আমাদের দেশে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দু’টি বিভাগ রয়েছে। তার একটি আইন ও বিচার বিভাগ, অপরটি লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ। তন্মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগের আওতাধীন নিবন্ধন অধিদপ্তরের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রি অফিসগুলো পরিচালিত হয়।এ অধিদপ্তরের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ে জেলা রেজিষ্ট্রার, সাব রেজিষ্ট্রার, নিকাহ রেজিষ্ট্রার এবং বিবাহ রেজিষ্ট্রারগণ কাজ করে থাকেন।এ অবস্থায় পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে যে সুবিধাটি বিদ্যমান থেকে যায়, জেলা রেজিষ্ট্রার এবং সাব-রেজিষ্ট্রারদের ভূমি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলেও যেহেতু নিকাহ রেজিষ্ট্রার ও বিবাহ রেজিষ্ট্রারদের কার্যক্রম থাকছে সেহেতু নিবন্ধন অধিদপ্তর পুরোপুরি বিলুপ্ত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে না।
প্রকৃতপক্ষে যে কারণে রেজিষ্ট্রি অফিসকে ভূমি মন্ত্রনালয়ের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে তা পূর্নাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে গেলে এ লেখা অনেক বেশী দীর্ঘায়িত হবে।সংক্ষেপে বলা যায়, ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্বতন্ত্র আইন ও বিধিমালা দ্বারা পরিচালিত হবার ফলে এবং আইনি বাধ্যবাধকতার ঘাটতি থাকায় অহরহ রেকর্ড বিহীন, প্রকৃত মালিকানা বিহীন, স্বত্ব-দখলহীন জমির দলিল সম্পাদন হয়েছে।২০০৫ সনে সম্পন্ন হওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু সংস্কারের মধ্যে দলিলের নতুন ফরম্যাট প্রবর্তন, বিক্রেতার নামে হাল রেকর্ড ব্যতীত দলিল সম্পাদন না করা, ক্রেতা-বিক্রেতার ছবি, এনআইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করার ফলে জালিয়াতি অনেকাংশে কমে আসলেও তদপূর্বে সম্পাদিত অসংখ্য দলিলে যে সমস্ত অসংগতি রয়ে গেছে তার জের আরো অনেককাল হয়তো সবাইকে সয়ে যেতে হবে।সে সময়ে ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের বাধ্যবাধকতা না থাকায় এক ব্যক্তির স্থলে অন্য ব্যক্তি দ্বারা দলিল সম্পাদনের মতো অসংখ্য ঘটনা এবং মামলা মোকদ্দমা সৃষ্টি হবার কথা আমরা সবাই জানি।তার
পাশাপাশি সাব রেজিষ্ট্রারদের বিক্রেতার মালিকানা সংক্রান্ত রেকর্ড দেখার আইনি বাধ্যকতা না থাকার ফলে মালিকানা না থাকা স্বত্তেও একজনের জমি অন্যজন বিক্রি করার সুযোগ ছিল।আমরা জানি, দেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতে চলমান মামলাসমূহের অধিকাংশই এসব ঘটনা সংশ্লিষ্ট।সমাজের অসাধু ও সুবিধাভোগী অংশের মাধ্যমে সৃষ্ট এসব জটিলতার কারণে সাধারণ নিরীহ মানুষজন মামলার বেড়াজালে আটকে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নিষ্পেষিত হচ্ছে।উল্লেখিত সংস্কারের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ হাল নাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ ব্যতীত দলিল সম্পাদন না করার বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। সেটিও নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে এতকিছুর পরও নানা উপায়ে নানা মাধ্যমে জালিয়াতি সংঘটিত হচ্ছে এবং আইন বহির্ভূতভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এখনো দলিল সম্পাদন যে হচ্ছে না তা বলার সুযোগ নেই।
সর্বশেষ প্রণীত নিবন্ধন বিধিমালা -২০১৪ এর অধ্যায়-৮ এর ৪২ নং অনুচ্ছেদে নিম্নরূপ বিধান দেখা যায়-
“নিবন্ধনের জন্য দলিল গ্রহণের অব্যবহিত পরবর্তী কার্যপ্রণালিঃ ৪২। নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা দলিলের বৈধতার সহিত সম্পৃক্ত নহেন।” কথা হচ্ছে যেখানে দপ্তর কর্তৃক প্রণীত বিধিমালায় একজন কর্মকর্তাকে এভাবে দায়মুক্তি দেয়া হয় সেখানে কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতামূলক মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ব্যাপৃত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এমতাবস্থায় নিবন্ধনকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব সম্পাদনকে আইনি বাধ্যকতার আওতায় আনা, বিক্রেতার হালনাগাদ মালিকানা ও রেকর্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দলিল সম্পাদন করাসহ ভূমি বিষয়ক নানাবিধ জটিলতা পরিহারকল্পে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের কার্যক্রম যত শীঘ্র সম্ভব ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনার কোন বিকল্প নেই।আমরা আশা করি অচিরেই মাননীয় ভূমি মন্ত্রীর মাধ্যমে এ উদ্যোগ সফল হবে এবং আপামর জনগণ এর সুফল ভোগ করবে।
সুমন চৌধুরী বিকু
গীতিকার, বাংলাদেশ বেতার।