প্রসঙ্গঃ মৃত্যু-ভাবনা
করোনাকালীন সময়ে মৃত্যুর সংবাদে ফেসবুক ভরে থাকতে দেখেছি। অজ্ঞাত কারণে আজ তিনদিন প্রচুর মৃত্যুসংবাদ দেখছি ফেসবুকে। ঠিক আজ তিনদিন আগে আমার একজন প্রিয় মানুষ নাদু ভাই মারা গেলেন। যিনি গত পনেরো দিন আগেও আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন সেলফোনে। সামনের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে যেনো একটা মার্কা দেই বলে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি শুনে বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না।
আমি এযাবৎকালের পর্যবেক্ষণ থেকে নিশ্চিত হয়েছি, আমরা অধিকাংশ মানুষই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকি না। আমরা মনে করি, আমাদের মৃত্যুর সময় হয়নি। হাতে এখনো যথেষ্ট সময় আছে। আমাদের লক্ষীপুর ইউনিয়ন আওয়ালীর সাবেক সাধারন সম্পাদক বাবলু সরকার নাকি চায়ের দোকানে তাঁর পাওনা পরিশোধ করে কিছু টাকা দোকানির কাছে রেখে যান। পাওনা টাকাটা ফেরত না নিয়ে দোকানিকে বললেন, “আগামীকাল আবার আসছি তো।” অথচ পরদিন তাঁর আর চায়ের দোকানে আসা হয়নি, তিনি সেই রাতেই মারা গেছেন।
কাউকে দেখেছি জমির জন্য নিজের ভায়ের সাথে ভয়ানক কলহ করার একদিন পরই তিনি দুনিয়াতে নাই। আমার ছেলেবেলার বন্ধু উপেন্দ্রনাথ এইচএসসি পাশ করার পর ভারতে চলে যান। পরিনত বয়োসে পশ্চিম বাংলা থেকে জন্মভূমিতে এসেছিলেন বেড়াতে। আমার সাথে দেখা করে ফিরে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “সামনের মাসে এসে তোর সাথে একটা রাত গল্প করে কাটাবো!” কিন্তু কয়েকদিন পরই তার মেয়ের টেলিফোনে মৃত্যুর খবর পেলাম। এধরনের শতেক ঘটনা আমার জানা!
এতে মনে হয়, আমরা কেউ মৃত্যু এখনই হতে পারে সেই প্রস্তুতি রাখিনা। ফলে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছি। মানুষের মনে কষ্ট দিচ্ছি। ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে হলেও টাকার পাহাড় জমাতে ব্যস্ত রয়েছি। পৃথিবীর বুকে অভিসম্পাত ছড়িয়ে দিচ্ছি কষ্টের, প্রতারণার। মিথ্যাচার, কুটকৌশল দিয়ে নিজেকে লাহবান করার চেষ্টা করছি। হারাম উপার্জন করে যাচ্ছি সন্তানের জন্য। হারামের পথটি চিনিয়ে দিচ্ছি নিজের সন্তানকে!
“অধিকাংশ” মানুষ মনে করে শব্দটি ব্যবহার করেছি এজন্য, কারণ এর ব্যতিক্রমও আছে। আমি আমার অতিস্বজন দুইজন মানুষের মৃত্যু দেখেছি সরাসরি খুব কাছে থেকে। যাঁরা তাঁদের মৃত্যুর পূর্বেই দিনক্ষণ বলে পৃথিবীর ময়া ত্যাগ করেছিলেন!
প্রথম জন হলেন, পাবনা জেলার অহংকার প্রয়াত পল্লী কবি বন্দে আলি মিয়ার বড়ো ছেলে মজনু ভাই। তিনি প্রতিদিন অনেকের মতো আড্ডা দিতে সন্ধ্যার পরে আমার রাধানগর বাসায় আসতেন। আমাদের একে অন্যের প্রতি গভীর ভালবাসার অনুভব ছিলো তাঁর চারিত্রিক কিছু উত্তম বৈশিষ্ট্যের জন্য। আমি ঢাকায় এসেছি কি যেনো কাজে! হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করে বললেন,ভাই আপনাকে জরুরী দরকার।
আমি বললাম কেনো?
তিনি বললেন, আমার জমিজমা ছেলেমেয়েদের ভেতরে ভাগ করে রেজিষ্ট্রি করে দেবো।
আমি বললাম, তা করতে হবে কেনো?
তিনি বললেন, কারণ আছে।
আমি কথা না বাড়িয়ে কাজটি করার জন্য আমাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের নাম বললাম। তিনি নাছোড়বান্দা। আমাকে ছাড়া তিনি এই কাজটি করবেন না। নিরুপায় হয়ে আমি পাবনায় গেলাম। আমি বললাম, ছেলেমেয়েদের এখনই জমিজমা ভাগ করে দিতে হবে কেনো?
তিনি বললেন, আমার হাতে একদমই সময় নেই। আমার অবর্তমানে যেনো কোনো পারিবারিক কলহ না হয়, সেইটা আপনার হাতে সবাইকে ভাগ করে দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিবেন।
আমি গভীরভাবে তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। মজনু ভাই শক্তিশালী মানুষ। শিশুর মতো সরল! ভ্রমন করেন। মাছ শিকারী। সত্যবাদী এবং স্পষ্টভাষী। ওয়াদা পালনে বিশ্বাসী। সাহসী ন্যায়পরায়ন। তিনি তখন পুরোপুরি সুস্থ এবং আচরণে চমৎকার শারীরিক চাঞ্চল্য রয়েছে। সামান্য রোগের কোনো ছাপ নেই। এইরকম একজন সুস্থ্য মানুষ যখন এই কথা বলছেন তখন আমার বাবার কথা মনে হয়ে চমকে গেলাম। কারণ আমার বাবার চরিত্রের সাথে মজনু ভাইয়ের চরিত্রের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
আমার বাবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত শারিরীকভাবে সক্ষম ছিলেন। কারো সাহায্য ছাড়াই হাঁটাচলা করতেন। সবার সাথে বসে গল্পগুজব করতেন, নামাজ আদায় করতেন। হঠাৎ শুক্রবার বিকেলে তিনি আমাদের সকল ভাইদের ডেকে একত্রিত করে বললেন, গ্রামের আশপাশের যাদেরকেই পাও সবাইকে একটু আমার কাছে ডেকে আনো। আমি কিছু কথা বলবো। আমরা বেরিয়ে গেলাম এবং বেশ কিছু লোক কে পেলামও। সবাই এসে বাড়ির উঠোনে দেয়া চেয়ার বেঞ্চে এবং চেয়ার বেঞ্চের স্বল্পতায় খেজুর পাতার মাদুর ইত্যাদিতে বসা। বাবা দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের বারান্দায় বসে, এলাকার সকলের কাছে ক্ষমা চাইলেন। তিনিও ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সেই সময় তিনি আমার দাদার মৃত্যুর গল্প শুনালেন সবার উদ্দেশ্যে। আমরা প্রথম আমার দাদার দুর্লভ মৃত্যুর ঘটনাটি সবার সাথে বসে বাবার মুখে শুনলাম।
আমার বাবার দাদা বেনোদ বিশ্বাসের বাহির বাড়িতে একটা ওয়াক্ত নামাজের ঘর ছিলো, যেটা দাদার সময়ে এসে গ্রামের জামে মসজীদে পরিনত হয়। দাদা দুপুরে গরম ভাত খেয়ে শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতে সেই মসজীদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষে দাঁড়িয়ে মুসুল্লিদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আগামী শুক্রবারে তোমরা আমাকে মাটি দিয়ে যেও।” একজন সুস্থ মানুষের মুখে এমন কথা শুনে কারোর কাছেই ততটা গুরুত্ব পেলো না, কারণ তখনও তাঁর শরীরে যৌবন রয়েছে। ঠিক পরের শুক্রবার খাওয়াদাওয়া করে মসজীদে গিয়ে নামাজ আদায় করে বাড়িতে এসে আমার দাদির কাছে আবার এক বাটি দুধভাত চাইলেন। দাদি বললেন, “আপনি একটু আগে খেয়ে মসজীদে গেলেন, আজ আবার পেটে রাক্ষস গেলো নাকি?” বলেই ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তৎকালীন কাঁসার জামবাটিতে দুধভাত এবং পানির পাত্র সামনে দিয়ে তিনি জরুরী কাজে বাইরে যান। কিছুক্ষন পরে এসে দেখেন, তিনি খেয়েছেন এবং বাটি এবং পানির পাত্র কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে উত্তর দিকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। দাদি তাঁকে ডেকে দেখেন তিনি চলে গেছেন।
আমার বাবা এই গল্পটি শুনিয়ে বললেন, “আমার মৃত্যুটাও ঠিক এভাবেই হবে।” তিনি বললেন না সামনের শুক্রবার আমি চলে যাবো। সেই দিনগত রাতের গভীরে বাবা আমাকে ডেকে বসতে বললেন এবং আমার জীবন নিয়ে কিছু ওছিয়ত করলেন। আমার জীবনাচরণ, ভবিষৎ করনীয়, এমনকি পথ চলতে কে আমার বিশ্বাসী এবং কাকে সাথে রাখবো সেই কথা পর্যন্ত। আমি বাবার সব কথা শুনে প্রশ্ন করি, “আপনি যদি হঠাৎ চলেই যান তাহলে আমি নির্বাচন করবো কিনা। আমার তো টাকাপয়সা নেই! আপনি রংপুরের জমি জমা বিক্রি করে আমাকে নির্বাচনে টাকা দিবেন বলেছিল।” আমার বাবা বললেন, তুমি নির্বাচন করবে। তোমার এক টাকাও লাগবেনা, তুমি এমপি হয়ে যাবে।” আমি বাবার কথা শুনে হতবাক। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনার এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি কি? বাবা উত্তর দিলেন, তোমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন মানুষের কাছে তোমার সম্পর্কে একটাও দুরু কথা (খারাপ কথা)শুনিনি।
যথারীতি পরবর্তী বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতের শেষ ভাগে, আযানের কিছু আগে, আমার বাবা আমাকে ডাক দিলেন! আমি তাঁর সাথেই শুয়েছিলাম। আমি বসলাম। তিনি বললেন, তোমার ভাইদের ডাকো। আমি সবাইকে ডেকে তুলে সামনে নিয়ে এলাম। তিনি বললেন, একজন ওপাড়ায় গিয়ে তোমাদের চাচাতো ভাইগুলোকে ডেকে আনো। আর ঘরের মেঝেতে উত্তর দক্ষিণ করে বিছানা করো। যথারীতি তাই করা হলো। আমার চাচাতো ভায়েরা এলেন। আমরা ১৮ ভাই বাবার সামনে। বাবা এই প্রথম মেঝেতে বিছানো তাঁর অন্তিম বিছানায় যাওয়ার জন্য আমাদের একটু সহযোগিতা চাইলেন। অর্থাৎ তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় দিতে হলো। তিনি বিছানায় শুয়ে, লা ইলাহা ইল্লাহহু মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ, কালেমাটি ননস্টপ পড়তে লাগলেন। আমি বাবাকে বললাম, আপনার জন্য আমি কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এনেছিলাম, সেটা কি একটু দিবো আব্বা? বাবা বললেন, তুমি জানোনা? জয় কালে ক্ষয় নাই মরণকালে ঔষধ নাই? আমার তো বেলা ডুবে গেছে বাবা। বলেই কালেমা পড়তে লাগলেন। আমাদের বংশের বড়ো ভাই বীর মুক্তযোদ্ধা মসলেম বিশ্বাস বললেন, চাচা, আমি আপনাকে একটু পানি দিবো? তিনি কালেমা থামিয়ে বললেন, দাও। বড়ো ভাই একটু পানি মুখে দিলে তিনি তা স্বাভাবিকভাবেই পান করলেন এবং কালেমা পড়তে পড়তে তাঁর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেলো এবং তিনি এক অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। বাবার মৃত্যু নিজের হাতের উপরে। এমন মৃত্যু আর কখনো স্বচক্ষে দেখিনি শুনিনি।
মজনু ভাই একই চরিত্রের। কিন্তু মজনু ভাই নামাজে ছিলেন অনিয়মিত। বাবা নামাজ পড়তেন ঠিকই কিন্তু নিজেদের পৈত্রিক ভিটার মসজীদেও শুক্রবারে যেতে দেখিনি। তিনি একা নামাজ আদায় করতেন। ইমামের চরিত্রের উপর আস্থা না থাকায় কারোর পেছনে নামাজ পড়তে কখনোই যাননি।
মজনু ভাই বাবার মতোই সহজ সরল মানুষ। আমি হামিদ মাষ্টার, ফুটু ভাইকে সাথে নিয়ে তাঁর জমিজমার ভাগযোগ করে দিলাম। রেজিষ্ট্রি অফিসে উনি আমাকে একা সাথে নিয়ে গেলেন। আমার মনে আছে, মজনু ভাই ফৌজদারি উকিলবারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন আর উদাসী চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম ভাই। একটাই কারণ, আমি দুনিয়াতে আপনাকে যতটা বিশ্বাস করি আর কারো প্রতি এই বিশ্বাস অতটা আনতে পারিনি। আমার যে হাতে আর সময় নেই। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মজনু ভাইয়ের মুখের দিকে। আমি বললাম, এসব কি বলছেন আপনি। আপনি সুস্থ, জুয়ান মানুষ। তিনি হাসলেন! বললেন, ভাই চলুন বাসায় যাই। দুজন একসাথে এসে তিনি তাঁর নিজের বাসায় গেলেন আমি আমার বাসায়।
সন্ধ্যায় মজনু ভাই হোহো করে হাসতে হাসতে আমার ড্রইংরূমে ডুকলেন। তখন জেলা আওয়ামীলীগ সহসভাপতি হামিদ মাষ্টার, জেনারেল নজরুলের ছোট ফুটু ভাই সহ বেশকিছু স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা রয়েছে ড্রইংরূমে। মজনু ভাই আমার হাতে এক প্যাকেট সিগারেট দিলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা কেনো? তিনি বললেন, আমার খুব ইচ্ছে হলো। আপনি নিন। আমি প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিলাম। বললাম, সিগারেটগুলো আপনি খেলে আমি খুবই খুশী হবো। তিনি আপত্তি করে ব্যার্থ হওয়ার পর মলীন মুখে প্যাকটি গ্রহণ করলেন।
অনেক রাতে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন মজনু ভাই। সকালে খবর পেলাম তিনি ভোর রাতে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজও সেই সিগারেটের প্যাকেটটি না নেয়ার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় আমার।
এধরণের মৃত্যু সবার কাছে আশা করা যায় না। জগতের অধিকাংশ মানুষ কখনোই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকেন না। অথচ আমাদের উচিত, প্রতিটি মুহুর্তকে জীবনের শেষ দিন বিবেচনা করে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া, মিথ্যা বর্জন করা, হারামের মোহ ত্যাগ করে মানবিক জীবনের উপাসক হওয়া। আসুন আমরা নিজেদের ভুল স্বীকার করি অকপটে। আমরা প্রস্তুত থাকি এইভাবে, যেনো এখনই আমার জীবনের শেষ সময়।
প্রার্থনা করি, পৃথিবীর সকল মানুষ তাঁর জীবনের কৃতকর্মের জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ লাভ করুন। উত্তম মানুষ হিসেবে সৎ জ্ঞনবান প্রজ্ঞাবান প্রজন্ম যেনো রেখে যেতে পারেন। মানুষ হোক, সত্য সুন্দরের উপাসক!