রামগড়ের দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি জনপদ আর পর্যটন স্পটগুলো প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে bডাকছে ভ্রমণ পিপাষু মানুষকে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা সদর হতে ৫০ কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রামগড় উপজেলা সদর। এই উপজেলার উপজেলা প্রশাসন কেন্দ্রিক ইংরেজি ডব্লিও বর্ণমালার আকৃতিতে ২৫০ মিটার লম্বা রামগড় পর্যটন লেক। শীতকালে অজস্র পরিযায়ী পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে ওঠে এখানকার প্রকৃতি। ছোটবড় অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা আর অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি এ জনপদ । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে খাগড়াছড়ি জেলা ছিল না। রামগড় মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল খাগড়াছড়ি। সময়ের পট পরিবর্তনের ধারায় খাগড়াছড়ি হয়ে যায় জেলা আর রামগড় হয় জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি উপজেলা।
সীমান্তবর্তী এই উপজেলাতেই সর্ব প্রথম জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) যা বর্তমানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)নামে পরিচিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কতৃক ১৭৯৪ সালে গঠিত ফ্রন্টিয়ার প্রটেকশন ফোর্স এর নাম পরিবর্তন করে ১৭৯৫ সালে ২৯ জুন রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামকরণ করা হয়। মাত্র ৪৪৮ জন সদস্য, ২ টি অনিয়মিত অশ্বারোহী দল নিয়ে ও ৪টি কামান নিয়ে এ বাহিনীর পদযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রামগড় রয়েছে আরও বড় সাক্ষী হয়ে । ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তখন তার প্রতিরোধে ২৬শে মার্চ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রাচীন জনপদের দামাল ছেলেরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই রামগড়ের মধ্যে দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে সেখানকার বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। মিএ বাহিনীর বিমান হামলায় ৬ ডিসেম্বর রামগড় পাক বাহিনীর অস্ত্র গুদামে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ৮ ডিসেম্বর রামগড় হানাদার মুক্ত হয়। এভাবে রামগড়বাসী পেয়ে যায় আজকের এই নয়ানাভিরাম পাহাড়ি জনপদ রামগড়।
রামগড়ের দুর্গম পাহাড়, বুনো অরণ্যে সাজানো চা বাগান আর বৈচিত্র্যময় নৃতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের ডাকেই নাগরিকতার মায়াজাল ছিঁড়ে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা চার বন্ধু নুরুল করিম (প্রধান শিক্ষক, মঃপ্রাঃবিঃ), নুরুল আবসার (সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী), আলমগীর মাসুদ (লেখক-সম্পাদক)। সকালের নরম রোদ ভেদ করে আমরা করেরহাট পার হয়ে ফেনী খাগড়াছড়ি সড়ক পথে যখন অগ্রসর হতে থাকলাম দু’পাশের পাহাড় তখন সকালের আড়ষ্টতা ভেঙে জেগে উঠছিল। উঁচু-নীচু এবড়োথেবড়ো রাস্তায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। কোথাও রাস্তা প্রশস্তের কাজ আবার কোথাও চলছে নতুন ব্রিজ নির্মাণ।
নয়নাভিরাম রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে ঢুকে পড়লাম ১,৪০০ একরের সুবিশাল রামগড় চা বাগানে। পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত এই চা বাগান থেকে প্রতিদিন ১৬ হাজার কেজিরও বেশি সবুজ পাতা উত্তোলিত হয়। সবুজে শ্যামলে যেন কী এক অপরূপ শোভা! একটু ভেতরের দিকে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায় লিচু, আম, কাঁঠালের বাগানের সৌন্দর্যে, মুগ্ধ করে লেবু আর আনারস বাগানের মনোরম দৃশ্য। চা-বাগানের মোহময় এক সম্মোহনী শক্তিতে আমরা এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম যে ছবি তোলার কথাই মনে ছিলোনা। ফেরার পথে তুলবো বলে চা-বাগান ভেদ করে মহামুনি পার হয়ে রামগড় বাজারে প্রবেশ করলাম আমরা। পরবর্তীতে সেখানে এসে আমাদের সাথে যোগ দেয় আরেক বন্ধু মাটিরাঙা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অজিত নাথ। আনন্দে আমরা যেন আত্মহারা, কথার খই ফুটছে সবার মুখে। লেকের পাড়ে চা-আড্ডা শেষে পায়ে হেঁটে ঝুলন্ত ব্রীজ পার হয়ে চলে এলাম আমাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুতে। দৃষ্টিনন্দন এ মৈত্রী সেতুটি পড়েছে উপজেলার সীমান্তবর্তী মহামুনি এলাকায়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফেনী নদীর ওপর ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু ১’ এর ভিত্তি ফলক উন্মোচন করেন। ২০২১ সালের ৯ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতুর উদ্বোধন করেন। সেতুটি একদিকে রামগড়ের বারৈইয়ার হাট-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে, অপরদিকে ভারতের নবীনপাড়া ঠাকুরপল্লি হয়ে সাব্রুম আগরতলা জাতীয় সড়কসহ রেলপথ যুক্ত হবে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক ৮০ মিটার প্রস্থ মৈত্রী সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৮২ কোটি টাকা। তবে ২৮৬ একর জমির ওপর নির্মাণ এলাকায় মূল সেতুটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর শুরু হওয়া সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি। মৈত্রী সেতুটি মোট ১২টির পিলারের মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ৮টি ও ভারতের অংশে ৪টি রয়েছে। এতে স্প্যান রয়েছে ১১টি। নদীর ওপর ৮০ মিটারের একটি স্প্যান ছাড়াও বাংলাদেশ অংশে সাড়ে ৩৩ মিটার দৈর্ঘ্যের ২টি, সাড়ে ২৭ মিটারের ৪টি ও ৫০ মিটারের একটি স্প্যান রয়েছেন। সেতুটি নির্মাণ করে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েস অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের (এনএইচআইডিসিএল) তানিশচন্দ্র আগারভাগ ইনপাকন প্রাইভেট লিমিটেড।
বহুল প্রতীক্ষিত মৈত্রী সেতুটি দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে জিপ, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলযোগে শত লোক ছুটে আসছেন। এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরের বুকে এমন একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু শহরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেবে। এর সঙ্গে রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে দুই দেশের বাণিজ্য, পর্যটন এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এর মাধ্যমে। সেতুটি উদ্বোধনের পর এখনও কাজে আসছে না স্থলবন্দর নির্মাণ না হওয়ায়। তবে ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাত রাজ্যকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সম্ভাবনাময় এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইতোমধ্যেই ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে সাব্রুম পর্যন্ত অর্থাৎ ভারতের অংশে নির্মিত হয়ে গেছে পাকা সড়ক, চলে এসেছে রেলপথ। এখন শুধু অপেক্ষা দুই প্রান্তে স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ। এর মাধ্যমে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রাম বন্দর এবং কক্সবাজারসহ বান্দরবান -রাঙামাটির সাথে যোগাযোগের পথ প্রশস্ত হবে যা আন্তজার্তিক বানিজ্যসহ ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের যে কটি স্থলবন্দর বেশ ব্যস্ততম তেমনই একটি বন্দর হবে রামগড়, এমনই মনে করছেন দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। খাগড়াছড়ির রামগড়ে আশা জাগাচ্ছে সীমান্তের ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু ’। এই মৈত্রী সেতুকে ঘিরে এলাকার আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে এবং পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে স্থানীয় প্রশাসন, পর্যটন কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার জোর তাগিত অনুভব করছেন এ জনপদের পাহাড়ি – বাংগালী-আদিবাসী সকল স্তরের মানুষ। রামগড় গড়ে উঠবে একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন শহর হিসেবে এ স্বপ্ন আমাকেও আনন্দিত করে।
সংবাদ সংগ্রহেঃ নুরুল আবছার, বিভাগীয় প্রধান,চট্টগ্রাম