মহিউদ্দিন ভুইয়াঃ মহান জাতীয় সংসদের উপনেতা, ও ফরিদপুর – ২ (নগরকান্দা ও সালথা) আসনের সংসদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র “গোবরা ক্যাম্প”-এর পরিচালক, বাংলাদেশ আওয়ামী মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের এইচডিইউ বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁর স্বামী বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৩৫ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার চন্দ্রগ্রাম-এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ শাহ্ হামিদুল্লা ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও স্বদেশী আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। মা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। দাদা সৈয়দ সাজ্জাদ জাফর ছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইনস্পেকটর; তিনি ব্রিটিশদের নানা অপকর্মের প্রতি বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেসের সদস্য হয়ে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে গান্ধীজির সাথে কারাভোগ করেন।
মাত্র ৯ বছর বয়সে সাজেদা চৌধুরী তার মাকে হারান। পরে দাদী আর ফুপুর কাছে লালিত-পালিত হন। দেশ- বিভাগ হলে ১৯৫০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরই সাজেদা চৌধুরী চট্টগ্রামের এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা ও ভাষাসৈনিক গোলাম আকবর চৌধুরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৪ সালে সাজেদা চৌধুরী চলে আসেন চট্টগ্রামে।
১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া সাজেদা চৌধুরী পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন (আপওয়া)-এর চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৬১ সালে। তিনি ‘৬২-এর হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন- বিরোধী আন্দোলন এবং ‘৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন ও ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের তিনি প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা ও জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে দেশের ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। সাজেদা চৌধুরী তখন কলাবাগানের মরিচা হাউসে বাস করতেন। মহিলা আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে মিসেস টিএন রশিদের পরিচালনায় মরিচা হাউসের সামনে প্রায় ২০০ নারীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ চলে একাত্তরের ৩ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত। ২৩ মার্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা মরিচা হাউস থেকে মার্চপাস্ট করে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা তুলে দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই প্রশিক্ষণার্থীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনে তিনি প্রতিদিন একাধিক জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। ২৬ মার্চ সকালে তিনি নিজের বাসা ছেড়ে পাশের একটি বাসায় আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল করা হলে তিনি নিজের গাড়ি নিয়ে আরিচার উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে চাচাতো ভাই প্রফেসর মুক্তাদির-এর হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদ হওয়ার খবর পান এবং ফিরে আসেন শাহজাহানপুরে তার চাচা সৈয়দ হাসান মাসুদের বাসায়। চাচাতো ভাইয়ের দাফন কাজ সম্পন্ন করে আবার নৌপথে যাত্রা শুরু করেন ভারতের উদ্দেশে। প্রথমে যান নরসিংদী, সেখান থেকে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। ওখানকার পরিস্থিতি বিপজ্জনক দেখে আবার ফিরে আসেন ভৈরবে, সেখান থেকে পরের দিন যান আশুগঞ্জে। সেখানকার অবস্থা আরও ভয়ানক ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে তখন পুরো আশুগঞ্জ এলাকা। ফিরে আসেন আবার ঢাকায়। সেখান থেকে ফরিদপুর হয়ে নড়াইল গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইসমত কাদির গামার সাথে তার দেখা হয়। ইসমত কাদির গামার সাথে সাজেদা চৌধুরী পরিবারের সকলকে নিয়ে টানা সাতদিন হাঁটার পর সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হন।
বাগদাতে সাজেদা চৌধুরীর জন্য অপেক্ষারত গাড়িতে তাদের সকলকে তুলে নিয়ে কলকাতার সার্কিট হাউসে পৌঁছায়। সেখানে সাজেদা চৌধুরীর সাথে দেখা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান হেনাসহ আরও অনেকের। এ সময় জাতীয় সংসদ বসার সিদ্ধান্ত হয় শিলিগুড়িতে। আওয়ামী লীগের যে সকল সংসদ সদস্য ভারতে ছিলেন তাদের অধিকাংশই সভায় উপস্থিত হন।
একাত্তরের মে মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকার নারীদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ক্যাম্পের পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে সাজেদা চৌধুরীর ওপর। জুন মাসের প্রথম দিকে মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতায় কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকায় গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন সাজেদা চৌধুরী। শুরু করেন নারীদের নার্সিং, ফার্স্টএইড, উদ্বুদ্ধকরণ ও সামরিক প্রশিক্ষণ। ১৬ জন করে কয়েকটি দলকে প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন ফ্রন্টে ও হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রশিক্ষণ চলতে থাকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ গার্লস ন্যাশনাল কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে টানা তৃতীয়বারের মতো মহিলা সংসদ উপনেতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য দেশি-বিদেশি পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।