আলমগীর আলমঃ ইদানীং আমাদের শহুরে মানুষের খাদ্যে নানা বৈচিত্র্য এসেছে। মানুষ এখন খাদ্য সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশ থেকে নানা খাবার এনে খাচ্ছে। মানুষের খাদ্যের চাহিদা অনুযায়ী আমদানিও হচ্ছে এমন বিদেশি খাবার বা খাদ্য উপকরণ। যেসব বিদেশি খাবার আমদানি হচ্ছে, তার বিকল্প কি আমাদের দেশে হয় না? এখানে অজ্ঞতা যেমন, তেমনি বিদেশপ্রীতিই মূলত এর কারণ। অথচ আমাদের প্রকৃতি যেসব খাদ্য ও খাদ্য উপকরণ উপহার দেয়, সেটা অনেক ভালো এবং আমাদের জন্য যথার্থ। কারণ, এসব উপকরণ এখানের আবহাওয়ায় উৎপাদিত হয়।
ইদানীং খুব চিয়াসিড খাওয়ার চল হয়েছে। বিদেশ থেকে বেশ আমদানিও হচ্ছে। মূলত আসছে বলিভিয়া আর ব্রাজিল থেকে। আমাদের পুষ্টিবিদেরা পরামর্শও দিচ্ছেন এটা খাওয়ার জন্য। আর তা খেয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি।
অথচ আমরা জানিই না, এই বিদেশি চিয়াসিডের বাংলাদেশের প্রজাতি কোনটা। আরে বাবা, সেটাই তো তোকমা! জেনে আশ্চর্য হবেন, চিয়াসিড আর তোকমা একই ধরনের বীজ, যা তুলসীর জাতের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে দেখতে একই রকম, তবে দুটি বীজের পুষ্টিমান খুব আলাদা নয়; বরং খাওয়ার বিভিন্ন উপায়, স্বাদ এবং অন্যান্য মিশ্রণের কারণে এর গুণ ভিন্ন বলে আমরা দাবি করি। বস্তুত খুব একটা পার্থক্য নেই।
দুটি বীজই তুলসী পরিবারের অন্তর্গত উদ্ভিদ থেকে আসে, তাই দেখতে একই রকম। এই দুটি বীজ সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যেতে পারে।
চিয়াসিড
প্রাচীন মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতায় মানুষের প্রধান ডায়েট হিসাবে পরিচিত ছিল চিয়াসিড। মধ্য আমেরিকা (গুয়াতেমালা) ও মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা (মেক্সিকো) অঞ্চলের স্থানীয় জাত হিসেবে পাওয়া যায়। সালভিয়া হিস্পানিকা (পুদিনা পরিবার) উদ্ভিদে জন্মে, যা মেক্সিকান চিয়া বা সেলবা চিয়া নামেও বিখ্যাত। মায়া ভাষায়, ‘চিয়া’ শব্দের অর্থ শক্তি। এর নামকরণ করা হয়েছে। কারণ, এটি মায়া যোদ্ধাদের জন্য শক্তি প্রদানকারী খাদ্য ছিল।
তোকমা
এই বীজ মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভারতসহ) এবং মধ্য আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল জন্মানো একটি জাত। এই উদ্ভিদ (Ocimum basilicum) মিন্ট পরিবারের সদস্য; মিষ্টি তুলসী বা থাই তুলসী নামেও পরিচিত। এগুলো সাবজা বীজ বা মিষ্টি তুলসী বীজ হিসাবেও জনপ্রিয়।
খাওয়ার নিয়ম
তুলসী এবং চিয়াসিড সাধারণত খাওয়ার আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। তোকমা চিবানো কঠিন, তাই তাদের আগে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তোকমা পানিতে ফুলতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় নেয়, আর চিয়া বীজ কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় নেয়।
স্বাদের পার্থক্য
তোকমায় একটি মৃদু গন্ধের পাশাপাশি ভেষজ তুলসীর গন্ধ রয়েছে। হালকা গন্ধের কারণে যে খাবারে তোকমা যোগ করা হয়, সেই খাবারে গন্ধের পরিবর্তন হয়ে থাকে। অন্যদিকে চিয়া বীজ মসৃণ এবং প্রায় স্বাদহীন। এটা যার সঙ্গেই মেশানো হোক না কেন, চিয়াসিডের কোনো গন্ধ পাওয়া যাবে না।
খাদ্য ও পানীয়কে সমৃদ্ধ করে
চিয়াসিড : নিজের ওজনের দশগুণ পানি শোষণ করতে পারে। এই ধরনের শোষণের সঙ্গে, এই ক্ষুদ্র বীজগুলো একটি দুর্দান্ত জোড়া লাগানোর এজেন্ট হয়ে ওঠে। ফলে বেক করার সময় ডিমের সঙ্গে দিয়ে পুডিং বানানো যাবে। আবার যেকোন জমানোর খাবারে এটা মিশিয়ে খাওয়া যাবে। সালাদ ও স্মুদিতে ছড়িয়ে কাঁচা চিয়াসিড খাওয়া যায়।
তোকমা: তোকমাও একইভাবে ব্যবহার করা হয়। পুডিং, ফালুদা, লেমনেড এবং পোরিজ তৈরি করতে তোকমা ব্যবহার করা যেতে পারে। এমনকি বেকিংয়েও ব্যবহার করা যায়। তোকমার সামান্য গন্ধ আছে; এ জন্য চিয়াসিডের মতো খাবারে তোকমা যোগ করা ততটা সহজ নয়।
পুষ্টিগুণ
এখন চিয়াসিড বেশ জনপ্রিয়। এর সঙ্গে তোকমার পুষ্টিগুণের তুলনামূলক পার্থক্যও দেখে নেওয়া যেতে পারে।
সহজেই বেশির ভাগ খাবার এবং পানীয়ের সঙ্গে মিশে যায়, এমন কোনো খাদ্য উপকরণ চাইলে চিয়াসিড বেছে নেওয়াটাই উত্তম। অন্যদিকে, পানি দ্রুত শোষণ করে সময় বাঁচায় এমন খাদ্য উপকরণ চাইলে তোকমা হবে সেরা।
আবার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে চাইলে উভয় বীজকেই বেছে নেওয়া যায। খাবারে পৃথকভাবে দুটোই মিশিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আর দুটি বীজ থেকেই মিলবে সমস্ত থেরাপিউটিক ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা। তবে কোনটা বেছে নেওয়া ভালো, কিংবা উভয়ই শ্রেয় কিনা, সেটার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটাই হবে যথার্থ।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র।